কোরবানির গোশতে সামাজিক অংশ: একটি পর্যালোচনা
প্রকাশ: ১৯ মে, ২০২৫, ০৯:০৩ রাত
নিউজ ডেস্ক

মুফতি জুবায়ের বিন আব্দুল কুদ্দুস 

ঈদুল আজহা, আমাদের ধর্মীয় দুটি উৎসবের অন্যতম, যেখানে কোরবানি একটি মৌলিক ইবাদত। আল্লাহর নামে ধনী ব্যক্তির কোরবানি করা এবং তার গোশত বিতরণ করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ঈদের আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে কোরবানির গোশত বিতরণের কোনো বিকল্প নেই। এটি শুধু মানবিকতারই নিদর্শন নয়, বরং ধার্মিকতারও প্রমাণ বহন করে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, فَکُلُوۡا مِنۡہَا وَ اَطۡعِمُوا الۡقَانِعَ وَ الۡمُعۡتَرَّ ؕ کَذٰلِکَ سَخَّرۡنٰہَا لَکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ 

অর্থাৎ, অতঃপর তখন তোমরা তা হতে আহার কর এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে ও প্রার্থনাকারী অভাবগ্রস্তকে। এইভাবে আমি ওদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।" (সূরা হজ্জ, আয়াত: ৩৬)

এছাড়া, কোরবানির গোশত তিন ভাগ করা মুসতাহাব— এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য, এবং এক ভাগ দরিদ্রদের হাদিয়া দেওয়ার জন্য। একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,  

كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ لُحُومِ الأَضَاحِي فَوْقَ ثَلاَثٍ لِيَتَّسِعَ ذُو الطَّوْلِ عَلَى مَنْ لاَ طَوْلَ لَهُ فَكُلُوا مَا بَدَا لَكُمْ وَأَطْعِمُوا وَادَّخِرُوا

অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তিকে কোরবানির গোশত তিন দিন পর খেতে নিষেধ করেছিলাম, যেন ধনী ব্যক্তিরা তাদের গোশত দরিদ্রদের মধ্যে দান করে। এখন তোমরা ইচ্ছামত তা খাও, অন্যদেরও খাওয়াও এবং জমা রাখলেও কোনো অসুবিধা নেই। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ১৫১০)

আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, فَكُلُوا وَادَّخِرُوا وَتَصَدَّقُوا


অর্থাৎ, এখন তোমরা খেতে পার, জমা করে রাখতে পার এবং সাদাকাহ করতে পার। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৯৯৭)

এই আয়াত ও হাদিস দ্বারা পরিষ্কার হয় যে, কোরবানির গোশত খাওয়া, অন্যদের দেওয়া এবং জমা রাখা সবই বৈধ। এর মানে হলো, শরীয়তে এই ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। তাই, এই বিষয়ে কারো জন্য কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা সঠিক নয়।

কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের কিছু অঞ্চলে কোরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ সমাজে বাধ্যতামূলকভাবে বিতরণ করতে হয়। এই গোশত ধনী-গরীব সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়। তবে এর পক্ষে শরীয়তে কোনো দলিল বা প্রমাণ নেই। বরং কিছু বিষয় গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সামাজিক গোশত সংগ্রহ এবং বন্টনের এই প্রথা কিছু ভুল ধারণা ও অপ্রীতিকর পরিণতি সৃষ্টি করছে, যা অনুচিত।

এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো-

১. কোরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরিবদের মাঝে বিতরণ করা আবশ্যক নয়; বরং এটি মুস্তাহাব বা উত্তম। সমাজে বাধ্যতামূলকভাবে তা গ্রহণ করা শরীয়ত দ্বারা নিষিদ্ধ।

২. নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনোই কোরবানির গোশত একত্রিত করে বিতরণ করতে বলেননি, যদিও তাঁর যুগে গরিব সাহাবীদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। এটি থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোরবানির গোশত বিতরণ যে একত্রিতভাবে করতে হবে এমন কোনো নির্দেশনা নেই।

৩. কোরবানির গোশত কোনো ব্যক্তির মান্নত হলে, তা তার পরিবার বা ধনী ব্যক্তির জন্য খাওয়া জায়েজ নয়। বরং তা বিতরণের উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হতে হবে।

৪. কোনো ব্যক্তি কোনো কারণে গোশত বিতরণে আগ্রহী না হলেও সমাজের চাপে বা লজ্জায় সমাজকে গোশত দিতে বাধ্য হন, যা তার সন্তুষ্টির বিরুদ্ধে। ইসলামে অন্যের সম্পদ তাদের সম্মতি ব্যতীত নেওয়া বৈধ নয়।

৫. এ ধরনের কাজকর্ম সমাজে মতানৈক্য, ঝগড়া-বিবাদ এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে এবং মানুষকে গুনাহের কাজে প্রবৃদ্ধি করে।

উপরের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই যে, কোরবানির গোশত সামাজিকভাবে সংগ্রহ ও বন্টন করা শরীয়তসম্মত নয়। এটি সঠিক পথে পরিচালিত না হলে তা কেবলমাত্র গুনাহের কারণ হবে, বরং যারা এটি পরিচালনা করেন, তারাও গুনাহের শিকার হতে পারেন।

সুতরাং সকল বিষয় হক্কানী ওলামায়ে কেরামের নির্দেশনা অনুযায়ী পালন করার চেষ্টা করা উচিত। 

তথ্যসূত্র: রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৮, ফাতাওয়ে হিন্দিয়া ৫/৩০০,  বায়হাকী ৬/১৮৬, বাদায়ে সানায়ে ৫/৮১, ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত ১১/২৫৮-২৬৫।

লেখক: শিক্ষক, জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ ঢাকা
খতিব, আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ
পরিচালক, দাওয়াতুস সুন্নাহ বাংলাদেশ

এমএইচ/