বড় আলেম হতে দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়া হলো না শহীদ নাহিদের
প্রকাশ: ০৪ জুন, ২০২৫, ০৮:০৭ সকাল
নিউজ ডেস্ক

দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছিল মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি। এদিন দুপুরেই খবর আসে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। এ খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসে।

১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পতনের আনন্দে  উদ্বেল লাখো জনতা বিজয় মিছিলে শরিক হয় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। রাজধানী ঢাকার আদবরে তেমনি এক বিজয় মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে এবং আগুনে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ১৬ বছরের কিশোর নাহিদ ইসলাম।

হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার মুড়িয়াউক গ্রামের বাড়িতে শিমুল গাছের ছায়ায় বেড়ে ওঠা নাহিদ মাত্র শিশুকালেই দুই মাসের ব্যবধানে হারান বাবা মাওলানা আব্দুল আজিজ (৫৮) ও মা নাছিমা আজিজকে (৫২)।

তিন ভাইবোনের মধ্যে ছোট নাহিদ পরিবারের সবার স্নেহ-ভালোবাসায় বড় হন। বড় বোন সাদিয়া সুলতানা দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বামীর সঙ্গে বসবাস করছেন। মেঝো ভাই মুফতি নাইমুল ইসলাম ঢাকার মীরপুরের দুয়ারিপাড়া এলাকায় মাদরাসায়ে মাদীনাতুল উলুম এতিমখানার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

নাহিদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় মাদরাসায়ে মাদীনাতুল উলুমে। পরে সে খুলনার মাদরাসাতুল কুরআন আল-আরাবিয়ায় মাদানী নেসাবের প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত ছিল।

নাহিদের ভাই মুফতি নাইমুল ইসলাম বলেন, ‘নাহিদ ২০১৭ সালে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর আমার  তত্ত্বাবধানে মাদরাসায়ে মাদীনাতুল উলুমে বেড়ে ওঠে। ছোটবেলা থেকেই সে খুবই সহজ-সরল ছিল। তরে খুব স্বাধীনচেতা ছিল। সে বিশ্বাস করত, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন জনস্বার্থে কাজ করছে।

নাহিদের বড় ভাই বলেন, ‘আমার আব্বা-আম্মার ইচ্ছে ছিল নাহিদ বড় আলেম হবে। আমরা জমি বিক্রি করে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের দারুল উলুম জাকারিয়া মাদরাসায় পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তা আর হলো না। আমাদের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল।’

নাহিদের ভাই মুফতি নাইমুল বলেন, ‘খুলনায় লেখাপড়া করলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সময় নাহিদ নিয়মিত আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিল। মাদ্রাসার শিক্ষকরা একপর্যায়ে অভিযোগ করেন, নাহিদ আন্দোলনে ব্যস্ত থাকায় প্রায়ই ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে। তখন পরিবার তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। নাহিদ জানায়, সে মোহাম্মদপুরে চাচার বাসায় থাকবে। আমরা সে সিদ্ধান্ত মেনে নিই।’

‘প্রায় ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার নাহিদ বয়সের তুলনায় পরিপক্ব ছিল। চিন্তায় স্বাধীন, মত প্রকাশে সাহসী ছিল সে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে তার ব্যক্তিত্বের গভীর প্রকাশ ঘটে।’

৫ জুলাই (২০২৪) বিকেলে চাচার বাসা থেকে বের হয়ে বিজয় মিছিলে যোগ দেয় নাহিদ। চাচাতো ভাইয়েরাও বিবজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু রাস্তায় তাদের দেখা হয়নি।

মিছিল আদাবর থানার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় থানা ঘেরাওয়ের চেষ্টা হয়। এসময় পুলিশ গুলি চালায়। এতে নাহিদসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নাহিদের বাম বুকে দুটি গুলি লাগে এবং সে দৌড়ে থানার এক পাশে গিয়ে বসে পড়ে। পরে তার মাথা ও বাম হাতে গুরুতর আঘাতের চিহ্নও পাওয়া যায়।

এসময় বিক্ষুব্ধ জনতা থানার সামনে একটি পরিত্যক্ত গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা নাহিদ তাতে অগ্নিদগ্ধ হয়। তার শরীরের বামদিক, মুখ থেকে পা পর্যন্ত পুড়ে যায়।

পরবর্তীতে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আদাবর থানার পুলিশ আহত ও নিহতদের পাশে নির্বিকারভাবে হাঁটছে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় থাকা নাহিদ ও অন্যদের ফেলে রাখা হয়। অনেক পরে স্থানীয়রা তাকে টেনে বের করেন। বিকাল ৫টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরিবার জানায়, নাহিদ বাড়ি না ফেরায় তারা সারা রাত তাকে খোঁজাখুঁজি করেন। পরে ৬ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে হাসপাতালের মর্গে নাহিদের লাশ শনাক্ত করেন তারা। সেখান থেকে লাশ নিয়ে মোহাম্মদপুরের মারকাযুল মসজিদে গোসল করানোর সময় তার পিঠ থেকে একটি গুলি বের করা হয়। পরে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে মা-বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়।

নাহিদের ভাই মুফতি নাইমুল ইসলাম বলেন, ‘নাহিদের মতো যারা নতুন বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে শহীদ হয়েছেন, তাদের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের সুষ্ঠু বিচার চাই। পরিবারের কেউ এমনভাবে প্রাণ হারালে সে শোক কেবল ভুক্তভোগীরাই বোঝে।’ সূত্র: বাসস

এনএইচ/