৫ ই জুন: আরব ইসরায়েল যুদ্ধ, আল কুদস-গাজ্জার দুর্দশার সূচনা
প্রকাশ: ০৫ জুন, ২০২৫, ০৩:৫৯ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

|| আতহার তানিম ||
 
সময়টা ছিল ১৯৬৭ সালের ৫ ই জুন, সকাল ৭ টা ৪৫ মিনিট। মিশরের বিমান বাহিনীর পাইলটরা প্রতিদিনের কাজে সক্রিয় হয়ে উঠেনি তখনো। ঠিক তখনি মিশরের বিমানঘাঁটিগুলো কেঁপে উঠে ইসরায়েলি জঙ্গিবিমানের হামলায়। হামলা করা বিমানের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ২০০। এই এয়ার স্ট্রাইকে মিশরের ৩৩০ টি বিমান এবং প্রায় ১০০ জন পাইলটের মৃত্যু হয়।
 
একই হামলায় জর্ডানের প্রায় ২৮ টি বিমানঘাঁটি ধবংস হয়ে যায়।
 
সে দিন থেকে শুরু হয় ৬৭ সালের ঐতিহাসিক ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ।
 
সে যুদ্ধের পরই সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমি, জর্ডানের কাছ থেকে পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীর এবং মিসরের কাছ থেকে সিনাই উপদ্বীপ ও গাজ্জা দখল করে নেয় জায়নবাদি ইসরায়েল। 
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগে বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন হুসাইনের সাথে ‘আল কুদস’ জর্ডানের অংশ মেনে নিয়ে গোপন চুক্তি হয়। যাতে জর্ডান ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিয়ে হস্তক্ষেপ না করে। কিন্তু অচিরেই তাদের আফসোস হয় এবং  নীল থেকে ফোরাত অবধী গ্রেটার ইসরায়েলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের আরেক ধাপের সূচনা ঘটে।  দীর্ঘ এক বছরে ছক আঁকা হয় আল কুদস তথা জেরুজালেম, সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি দখল করার। 
 
১৯৬০ সালে ইসরায়েলের আগ্রাসি মনোভাবের প্রতিউত্তরে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের তিরান প্রণালী বন্ধ করে দেন ও সিনাই সিমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেন। যাকে বলে “ব্রিঙ্কম্যানশিপ নীতি”। যা ছিল যুদ্ধউন্মাদ শত্রুকে ঠাণ্ডা রাখার কৌশল। 
 
কিন্তু ইসরায়েল তার ‘গ্রেটার স্টেট’ বাস্তবায়নের জন্য এই প্রতিরোধ-পদ্ধতির অপব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়।
 
১৯৬৭ সালে মে মাসে রুশ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জামাল আব্দুন নাসের জানতে পারলেন ইসরায়েল যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট তখন এই মনোভাব দমন করতে সিনাই সিমান্তে এক লক্ষ সেনার সমাদেশ ঘটান। মে মাসের শেষ দিকে তিরান প্রণালি বন্ধ করে দেন। আর এটার জন্যই যেন ইসরায়েল অপেক্ষা করছিল।
 
৫ জুন এক ঝাঁক ইসরায়েলি জঙ্গিবিমান মিশর,জর্ডান,সিরিয়া ও ইরাকে প্রচণ্ড বিমান হামলা করে তাদের বিমান বাহিনীকে প্রায় অকেজো করে ফেলে। আকাশ অভিযানের পরপরই স্থল অভিযান শুরু হয়। সীমান্তসংলগ্ন ‘গাজ্জা’ সর্বপ্রথম শিকার হয় দখলদারিত্বের।
 
যুদ্ধের ৩য় দিনে পূর্ব জেরুজালেম ইসরায়েলের দখলে চলে যায়। দখল করে নেয় সিনাই উপত্যকার বিস্তৃত ভূমি। 
 
জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্টের দখল জায়নবাদি ইহুদি সেনাদের সাহসকে আরো বাড়িয়ে দেয়। 
 
৪র্থ দিনে পুরা সিনাই উপদ্বীপ চলে আসে ইসরায়েলি বাহিনীর করায়ত্তে। মিশর ও জর্ডানের পর ইসরায়েল নজর দেয় সিরিয় ফ্রন্টে। রুক্ষভূমি হওয়া সত্ত্বেও দুই দিনের মধ্যেই গোলান মালভূমি কব্জা করে নেয় তারা। 
 
যুদ্ধের ৭ ম দিনে জাতিসংঘের সাজানো যুদ্ধবিরতিতে আরব দেশসমূহ ও ইসরায়েল সম্মত হয়। এই যুদ্ধবিরতি  হয় নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ রেজ্যুলেশনের উপর ভিত্তি করে,অর্থাৎ 'ল্যান্ড ফর পিস' —দখলকৃত ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে শান্তি চুক্তি। কিন্তু ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ছাড়া চুক্তির অন্যান্য শর্ত পালনে কোনো ভ্রুক্ষেপই করেনি। 
 
ছয় দিনে ইসরায়েলের আয়তন যুদ্ধপূর্ব ইসরায়েলের প্রায় চারগুণ হয়ে দাঁড়ায়। অর্ধ শতাব্দি পরও এই যুদ্ধের ক্ষত এখনো মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে আছে। 
 
১৯৭২ সালে ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে মিশর সিনাই উপদ্বীপ পূনর্দখল করে নিতে সক্ষম হয়।  কিন্তু গাজ্জা,আল কুদস,গোলান মালভূমি থেকে যায় ইসরায়েলের করায়ত্তে। 
 
এই যুদ্ধে বিশাল আর্থিক ক্ষতির সাথে সাথে আরবদের বিশ হাজার সেনা প্রাণ হারায়। বিপরিতে ইসরায়েলের নিহত হয় ১০০০ সেনা ও ৬০ টির মতো বিমান। ইউনাইটেড আরব রিপাবলিকের বিশ্বখ্যাত রাষ্ট্রপ্রধান জামাল আব্দুন নাসের এই যুদ্ধের পর পদত্যাগ করেন। ছয় দিনের এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জন্ম নেয় ফিলিস্তিনের বামপন্থী,সমাজতান্ত্রিক সশস্ত্র সংগঠন PLFP (পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্যা লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন),যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জর্জ হাবাশ। 
 
সার্বিকভাবে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের এই যুদ্ধের ফলাফল এখনো পুরো বিশ্ব মানবতা—বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের এক দগদগে ঘা হয়ে আছে। মাসজিদুল আকসা,গাজ্জা,গোলান মালভূমি এখনো ছয় দশকের পরাজয়ের গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে।
 
লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া,উত্তরা,ঢাকা
 
এমএইচ/