চামড়া কালেকশন নিয়ে বিকল্প ভাবনা ও কিছু কথা
প্রকাশ: ১০ জুন, ২০২৫, ১১:১৬ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

|| আবু নাঈম ফয়জুল্লাহ ||

চামড়া কালেকশন নিয়ে নানা ধরনের কথা হচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ এটাকে এখন আত্মসম্মানহীন কাজ মনে করছেন। বাস্তবতাও অনেকটা এমনই। অন্তত চামড়া কালেকশন যে সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা নয় এটা সবাই মানবেন। কিন্তু সমস্যা হলো, বিকল্প কী? 

এর উত্তর এককথায় দেওয়া মুশকিল। আসলে সবকিছুর বিকল্প লাগে না। সমাজ সব সময় একই কাঠামো মেনে পরিবর্তন হয় না। সমাজ নানা ঘটনা, অনুঘটনা ও মহাঘটনার কারণে নিজস্ব গতিতে বদলাতে থাকে। সমাজ কখনও আপনার আমার সুবিধা অসুবিধার তোয়াক্কা করে না। তবে আমাকে আপনাকে সমাজের পরিবর্তনকে তোয়াক্কা করতে হয়। সমাজের পরিবর্তনের গতি বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। না হয় আমরা হারিয়ে যাই। 

পৃথিবীতে এক সময় বিদ্যুৎ ছিল না, তখন কুপিবাতি, মোমবাতির আলোই ছিল একমাত্র অবলম্বন। অতঃপর যখন বিদ্যুৎ এলো তখন কিন্তু শুধু কুপিবাতি ও মোমবাতির উত্তম বিকল্প হিসেবে আসেনি, এসেছে জীবনের সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটাতে। নতুনভাবে পুরো সমাজ কাঠামোকে বিন্যস্ত করেছে। বিদ্যুৎ শুধু ঘরকে আলোকিত করেনি, বরং বাড়ি ঘরের কাঠামোকেও বদলে দিয়েছে। সাথে সাথে এমন নতুন কিছু তৈরি করেছে যার কল্পনাও আগে করা সম্ভব ছিল না। 

চামড়া কালেকশনের বিকল্প যদি আমরা এভাবে খুঁজতে থাকি যে, কুরবানির ঈদে চামড়া কালেকশনের মাধ্যমে যেই টাকাটা আসে তার সমপরিমাণ টাকা অন্য কোন পন্থায় কীভাবে আসতে পারে? তাহলে চিন্তাটা হবে খুবই সীমাবদ্ধ চিন্তা। এবং এতে ভালো কোনো বিকল্প পাবো বলেও মনে হয় না। বরং এতে এমন কোনো সিদ্ধান্তের দিকে আমরা ধাবিত হবো যা নতুন কোনো জুলুমের পথ তৈরি করবে। 

তাহলে আমরা কীভাবে চিন্তা করবো? আমাদের চিন্তা করতে হবে পুরো আর্তসামাজিক পরিবর্তন নিয়ে। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আর্তসামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানুষের চিন্তাগত যেসব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা আমলে নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। 

এই সময়ে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ফান্ডিং কীভাবে হয় তার অলিগলি হাতড়ে দেখতে হবে। মানুষের দান দক্ষিণার মোটিভগুলো কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, কেন নিচ্ছে তা বুঝতে হবে। আমাদের চলমান সিস্টেক কেন সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা মানুষের বুঝতে পারতে হবে। না হয় সমাজ আমাদের টিকতে দিবে না। 

এইসবকিছুসহ আরো অনেককিছুর সাথেই আসলে অর্থনীতির সম্পর্ক। 

বর্তমান বাস্তবতায় মাদরাসাগুলোর অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য যে ব্যাপারগুলো নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা দরকার তা হলো— 

১. ছাত্রদের খাবার-দাবারের দায়িত্ব ব্যাপকভাবে মাদরাসার কাঁধে নেয়ার বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করা। এই দুর্মূল্যের বাজরে, ভেজাল খাদ্যেভরা এই সমাজে একজন মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণ করা চাট্টিখানি কথা না। এত এত ছাত্রের থাকা খাওয়ার জিম্মাদারি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আজকের এই সময়ে কেন আমরা আবশ্যক করে রেখেছি তা অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করতে হবে। একটা সময় ছিল, যখন শত শত মাইলের মধ্যে মাদরাসা খুঁজে পাওয়া যেতো না। যাতায়াতব্যবস্থা এমন ছিল যে, বছরে এক দুইবারের বেশি চাইলেও বাড়িতে আসা যেতো না। এজন্য ছাত্রদের থাকা খাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করা করা ছাড়া উপায় ছিল না।  

এখন সেই অবস্থা নেই। ৪০/৫০ কিলো দূর থেকেও নিয়মিত অফিস করার যুগে আমরা বাস করছি। সুতরাং কেন আমরা আরেকটু স্বাধীনভাবে চিন্তা করবো না? 

হ্যাঁ, যাদের সামর্থ্য আছে তারা অবশ্যই গরিব অসহায়দের পূর্ণ যিম্মাদারি গ্রহণ করবেন। কিন্তু মানহীন ও মানবেতর থাকা খাওয়া দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বোঝা নিজেদের কাঁধে নেয়া কেন প্রয়োজন তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। 

২. শিক্ষকদের মানোন্নয়নের মাধ্যমে অল্প সময়ে বেশি ফায়দা নেওয়ার জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রতি জোর দেওয়া। মানহীন শিক্ষকের পনের ঘণ্টার মেহনত মানসম্পন্ন শিক্ষকের পাঁচ ঘণ্টার সমান। আর পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা শিক্ষকদের সৃজনশীলতাকে শাণিত করে। 

এই ব্যাপারটার সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা উতোপ্রোতভাবে জড়িত। তাই শিক্ষকদের মানোন্নয়ন করে তাদেরকে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা বেঁধে দিলে মাদরাসাগুলোর ওপর অর্থনৈতিক চাপ অনেক কমে আসবে। 

৩. মাদরাসাগুলোর নিজস্ব স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করার প্রতি উৎসাহিত করা। যেভাবে প্রতি বছরের ব্যয় নির্বাহের জন্য কালেকশন করা হয়, ঠিক সেভাবে যদি মাদরাসার খরচ নির্বাহের জন্য স্থায়ী ইনকাম সোর্স গড়ে তোলার চেষ্টাও করা হয় তাহলে একটা সময় পর ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে বলেই আমার বিশ্বাস। 

৪. মাদরাসার সংখ্যা কমিয়ে মানসম্মত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য বোর্ডগুলোর পক্ষ থেকে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এলাকা ও জনসংখ্যাভিত্তিক শর্ত, মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত, এবং প্রয়োজনে দুই তিন মাদরাসার স্থাবর সম্পদকে একত্র করে এক মাদরাসায় রূপান্তর করার কার্যকরি রূপরেখা নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।

মাদরাসার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াও মানুষের দানের ক্ষেত্রে বিতৃষ্ণার একটা কারণ। মাদরাসার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান বের করা এ যুগে সত্যিই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যেখানে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার কারণে ব্যক্তিঅর্থনীতিই আজ হুমকির মুখে।

তথাপি এটা বাস্তব, কোনো সমস্যাই সমাধান অযোগ্য নয়। প্রয়োজন শুধু ব্যক্তিস্বার্থের ওপর উম্মাহর স্বার্থ নিয়ে ভাবা। চর্চিত সিস্টেমের সীমাবদ্ধ গণ্ডি থেকে নিজের চিন্তাশক্তিকে আগে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে ভাবা। এবং একমুখী চিন্তা থেকে বেরিয়ে বহুমুখী চিন্তার পথকে উন্মুক্ত করা।

লেখক: আলেম লেখক, চিন্তক ও মাদরাসা শিক্ষক