জজবা ভালো, তবে ভুল প্রতিক্রিয়া খুবই খারাপ
প্রকাশ:
০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৪:২৯ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
|| আরিফ আজাদ || আমরা সবাই জানি, পবিত্র কাবা ঘর সর্বপ্রথম নির্মাণ করেছিলেন আমাদের পিতা ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। তিনি তাঁর পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামকে সাথে নিয়ে, মরুভূমির বালুকাময় উপত্যকার সেই বিজন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে, পাথরের উপর পাথর দিয়ে বিনির্মাণ করেন বাইতুল্লাহ। কিন্তু, বর্তমানে আমরা বাইতুল্লাহকে যেভাবে দেখি, ইবরাহিম আলাইহিস সালামের হাতে নির্মিত বাইতুল্লাহ কি দেখতে ঠিক এমনই ছিল? উত্তর হচ্ছে—না। এই ইতিহাসটুকু জানতে হলে আমাদেরকে একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে। রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স তখন ৩৫ বছর। সে-বছর মক্কায় প্রচণ্ড রকমের বন্যা হয়। বাইতুল্লাহর চারপাশে ছিল অসংখ্য ছোট বড় পাথুরে পাহাড়। সেইসব পাহাড় থেকে বন্যার ঢল নেমে এসে বাইতুল্লাহর দেয়ালে আছড়ে পড়তে পড়তে বাইতুল্লাহর দেয়াল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরেকটা অপ্রীতিকর একটা ঘটনাও সে-বছর ঘটেছিল। একদল নরাধম বাইতুল্লাহর দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে, ভেতরে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। ফলে বন্যা আর লুটপাট, দুই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তখনকার মক্কাবাসী সিদ্ধান্ত নেয় যে—বাইতুল্লাহকে আগাগোড়া ভেঙে সংস্কার করা হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাইতুল্লাহকে ভাঙা হলো। একেক গোত্রের কাঁধে বাইতুল্লাহর একেক পাশের দেয়াল নির্মাণের দায়িত্ব পড়ে। সবাই একটা বিষয়ে সম্মত হয় যে—বাইতুল্লাহর পুনঃনির্মাণ কাজে কেউ তাদের হারাম টাকা ব্যবহার করবে না। অর্থাৎ সুদ, ব্যভিচার হতে লব্ধ অর্থ ইত্যাদি বাইতুল্লাহর নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা যাবে না। শুধুমাত্র হালাল উৎস থেকে উপার্জিত অর্থই এই কাজে ব্যয় করা যাবে। বাইতুল্লাহর চারটা দেয়াল। এরমধ্যে উত্তর দিকের দেয়াল নির্মাণের দায়িত্ব পড়ে বনু আদি বিন কাব বিন লুওয়াই গোত্রের উপর। কিন্তু হায়, তাদের কাছে পর্যাপ্ত হালাল অর্থ মজুদ না থাকায় তারা উত্তরাংশের সেই দেয়াল নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়। সেই যে তারা উত্তরের দেয়াল নির্মাণ করতে পারল না, বাইতুল্লাহর সেই দেয়াল আজও সেভাবেই আছে। বাইতুল্লাহর যে অংশটাকে আমরা হাতীম বলে চিনি, সেটাই মূলত বনু আদি বিন কাব বিন লুওয়াইয়ের অসমাপ্ত রেখে দেওয়া অংশ। হাতীম শব্দের অর্থই হলো—পরিত্যক্ত। হাতীম মূলত কাবারই অংশ। এজন্যেই হাজিদেরকে হাতীমের বাইরে দিয়ে তাওয়াফ করতে হয়। যাহোক, সেবার তো বাইতুল্লাহ পুনঃর্নিমিত হলো, কিন্তু ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নির্মাণ করা আকৃতি থেকে কিছুটা রদবদল হয়ে গেল। হাতীমের অংশটা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নির্মাণ করা আকৃতিতে বাইতুল্লাহর ভেতরেই ছিল। কিন্তু হাজার হাজার বছর পরে এসে, কুরাইশেরা যখন এটার পুনঃনির্মাণ করল, তাতে হাতীম তথা উত্তরের অংশটা বাইরে থেকে গেল। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নির্মিত বাইতুল্লাহয় দরোজা ছিল একদম নিচে। অনায়াসে মানুষ ঢুকতে পারত সেই দরোজা দিয়ে। কিন্তু কুরাইশেরা দরোজা রাখল বেশ উঁচুতে, যাতে চোরের দল আর কখনো বাইতুল্লাহয় ঢুকতে না পারে। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নির্মিত বাইতুল্লাহয় দরোজা ছিল দুটো। একটা পূর্বে, অন্যটা পশ্চিমে। মানুষজন পূর্ব দরোজা দিয়ে প্রবেশ করত, প্রার্থনা শেষে পশ্চিম দরোজা দিয়ে বেরিয়ে যেত। কিন্তু কুরাইশেরা পশ্চিমে কোনো দরোজা রাখেনি। মোটামুটি ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নির্মিত বাইতুল্লাহর আকৃতির সাথে কুরাইশদের হাতে পুনঃনির্মিত বাইতুল্লাহর এমনকিছু পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু, নবিজি সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে সর্বদা সেই ইবরাহিমি আকৃতির প্রতি একটা টান বিদ্যমান ছিল। মক্কা বিজয়ের পর তিনি কুরাইশদের হাতে গড়া আকৃতি ভেঙে দিয়ে, ইবরাহিম আলাইহিস সালামের হাতে গড়া আকৃতির বাইতুল্লাহয় ফেরত যেতে চেয়েছিলেন। তবে, খুব ইচ্ছাপোষণ করলেও শেষ পর্যন্ত নবিজি সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কাজ করেননি। তিনি এই ভয় পেয়েছিলেন যে—তিনি যদি কুরাইশদের হাতে নির্মিত বাইতুল্লাহ ভেঙে, ইবরাহিমি আকৃতিতে ফেরত যান, এই ঘটনা নতুন ইসলাম গ্রহণ করা মক্কার লোকজনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। এই যে ইবরাহিমি আকৃতিতে নবিজি শেষ পর্যন্ত ফেরত গেলেন না নতুন মুসলিমদের মনোভাব বিবেচনা করে, এটাই হলো হিকমাহ তথা কৌশল। নবিজি সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স। (খ) নুরা পাগলা নামের কোনো এক ভণ্ড নিজেকে ইমাম মাহদি দাবি করত এবং তার মৃত্যুর পর, তারই বাড়ির উঠোনে তার মৃতদেহকে বিশেষ কায়দায় দাফন করা হয়। মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে। তার কবরকে ঘিরে যে স্থাপনা তার শাগরেদ তথা ভক্তকূলেরা তৈরি করেছিল তা ছিল প্রায় হুবহু কাবা ঘরের আকৃতিতে। নাউযুবিল্লাহ। এটা শারিয়াহর স্পষ্ট লঙ্গন এবং চরম মাত্রার বাড়াবাড়ি। অনেক প্রতিরোধ, প্রতিবাদ এলাকার সচেতন লোকজন জানিয়ে আসছিল বহুদিন থেকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও, নুরা পাগলার ভক্তবৃন্দও এতে গা করে না, স্থানীয় প্রশাসনও রা করে না। শেষমেশ কী হলো? এলাকার লোকজন গিয়ে নুরা পাগলের সেই কাবা আকৃতির মাজার ভেঙে দিলো এবং তার মৃতদেহকে কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলা হলো। কাবা আকৃতির যে মাজার তারা তৈরি করেছে, সেই মাজারটা ভেঙে ফেলা অবধি ঠিক ছিল। কারণ এইটাকে নিয়ে দুনিয়ার কেউ রাজনীতি বা বয়ান তৈরি করতে পারত না। কাবা হলো মুসলমানদের সর্বোচ্চ পবিত্র স্থাপনা। সেই পবিত্র স্থাপনার ব্যাপারে কোনো ছাড় কখনোই বরদাস্ত করার মতো নয়। কিন্তু বিপদ হলো, গোটা দুনিয়াতে এখন এই এই ঘটনাকে ফ্রেইমিং করা হবে ভিন্নভাবে। তারা বলবে—বাংলাদেশের মুসলমানেরা এত অসহিষ্ণু, এত উগ্র আর বর্বর যে, কবর থেকে মৃতদেহ তুলে এনে তারা পুড়িয়ে ফেলে। সত্যি বলতে এরকম ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এবং এই ঘটনার রাজনৈতিক বয়ান আর কনসিকোয়েন্স যে কীভাবে আসতে পারে তা আমাদের ধারণারও হয়ত বাইরে। আল্লাহ হিফাযত করুন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে তাকান। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল বাইতুল্লাহকে ইবরাহিমি আকৃতিতে ফিরিয়ে নেওয়ার। কিন্তু তিনি সেই কাজ করেননি। কারণ, তিনি তার সময়কার আর্থ সামাজিক অবস্থাকে তাঁর ইচ্ছার উপরে স্থান দিয়েছেন। তিনি যদি সেদিন বাইতুল্লাহকে ভাঙতে যেতেন, তাহলে সদ্য ইসলামে আসা অসংখ্য মানুষের মনে সেই ঘটনা যে বিরূপ প্রভাব ফেলত, সেটাকে তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। গোয়ালন্দে যে ঘটনাটা ঘটল, কবর থেকে মৃতদেহ তুলে পুড়িয়ে ফেলা—এই ঘটনাতে ইসলামপন্থীদের কী বিজয় অর্জিত হয়েছে জানি না। তবে অনেক সাধারণ মুসলিম, যাদের ধর্মীয় জ্ঞান একেবারে অপ্রতুল, তাদের মনে এটা বেশ বাজেভাবে দাগ কেটে যেতে পারে। এই ঘটনাকে দেশে এবং বিদেশে খুব চতুরতার সাথে ফ্রেইমিং করা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। মুসলমানরা কতো খারাপ, কতো অসভ্য, বর্বর এসব বয়ান তৈরি কাজে ঘি ঢালা হলো এমন একটা কাজে। অবশ্য, এখানে সরকার আর প্রশাসনের দায়টাও কম কোথায়? এতোদিনের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর বাদানুবাদের ঘটনাতে তারা কি জানত না যে—পরিস্থিতি এমন একটা দিকে মোড় নিতে পারে? আর কতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে সরকারের প্রশাসন নড়েচড়ে বসবে আর এই ধরনের বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার আগে সুরাহা করার দিকে ঝুঁকবে তা বলতে পারি না। সবশেষে বলি—জজবা নিঃসন্দেহে ভালো জিনিস। তবে তার ভুল প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে অধিকাংশ সময়। লেখক: দাঈ, চিন্তক ও জনপ্রিয় লেখক এসএকে/ |