এবার হাটহাজারীতে ১২ রবিউল আউয়াল কেন এমন হলো?
প্রকাশ:
১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৩:৫০ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
|| মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী || ১২ রবিউল আউয়াল তারিখ চট্টগ্রামে জশনে জুলুস অনুষ্ঠিত হয়। জশনে জুলুস অর্থ উৎসব উপলক্ষে মিছিল বা শোভাযাত্রা। যারা এটি করেন তারা ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে করেন। শাব্দিক অর্থে ঈদে মিলাদ অর্থ জন্মদিনের উৎসব। মুসলমানরা নবী করিম (সা.) এর বরকতময় জীবনী আলোচনা ও দুরুদ মাহফিলে নবীজির জন্ম বৃত্তান্ত অংশটি আলোচনার সময় এর নাম দেন মিলাদ বা মাওলিদ। কেউ আবার মৌলুদ শরীফও বলেন। এটি নবী করিম (সা.) এর মুজেজাপূর্ণ এবং অনন্য জীবন বৃত্তান্তের প্রতীকি নাম। যা সারাবছর যে কোনো উপলক্ষ, দিন বা সময়ে করা যায়। মিলাদুন নবীর আলোচনা এক জিনিস আর এর আওতায় নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত ও স্বর্ণযুগের রীতি পদ্ধতির বাইরে গিয়ে অনুষ্ঠান করা ভিন্ন জিনিস। উতসব পালনের সময় শরীয়ত বিরোধী অনুষঙ্গ যুক্ত করা এবং মিলাদুন নবীর বিষয়টিকে বুঝে না বুঝে ধীরে ধীরে অমুসলিম বিজাতীয় সংস্কৃতির মতো বানিয়ে ফেলা ইসলামের জন্য খুবই ক্ষতিকর প্রবনতা। মিলাদে মসীহ আ. যেমন খৃস্টানরা বড় দিন হিসাবে পালন করে। হিন্দুরা শ্রী কৃষ্ণের জন্মদিন পালন করে জন্মাষ্টমী। মুসলমানদের কাজ কর্ম উতসব অনুষ্ঠান সবই হতে হবে বিধর্মীদের চেয়ে ভিন্ন এবং সাদৃশ্যমুক্ত। গুনাহ, অপচয়, হিংসা বিদ্বেষ, বিদাত ও শত্রুতামুক্ত। নবী করিম (সা.) উপর দুরুদ সালাম তাঁর জীবন ও শিক্ষার আলোচনা দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেক আমল। অনেকে বিশেষ দিনে বিশেষ পদ্ধতিতে এটি পালন করেন। অনেকে নির্দিষ্ট দিবসে করেন না। তারা মনে করেন এবং সবারই মনে করা উচিত যে, নবী করিম (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা মুসলমানের ঈমানের মূল। তার প্রতি দুরুদ ও সালাম মুসলমানের প্রাত্যহিক ফরজ ইবাদতের জরুরি অংশ। তার প্রতি স্মরণ ও শ্রদ্ধা ছাড়া মুসলমানের একটি দিনরাতও পার করা সম্ভব নয়। তাছাড়া নবী করিম (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো আনুষ্ঠানিকতাকে কেউই ফরজ ওয়াজিব বলেন না। এসব ক্ষেত্রে জায়েজ ও মুবাহ যেকোনো পদ্ধতি সবার জন্য উন্মুক্ত। যারা উম্মতের মধ্যকার প্রচলিত নির্দোষ রীতি সংস্কৃতিকে মুস্তাহাব বা মুস্তাহসান গণ্য করে পছন্দ করেন তাদের বিষয়ে কোনো আলেমই বাড়াবাড়ি মন্তব্য বা কঠিন সমালোচনা করেন না। তবে কোনো ক্ষেত্রে যদি নবী করিম (সা.) এর স্মরণে অনুষ্ঠিত আলোচনা, না’ত, কাসিদা, জুলুস, মিছিল ইত্যাদিতে অমুসলিম বিজাতীয় কওমের উৎসবের মতো কিংবা প্রচলিত দুনিয়াবী উৎসবের মতো শরীয়তবিরোধী কর্মকাণ্ড, পর্দা লংঘন, নাচগান বা আদবের খেলাফ কোনো কাজ প্রকাশ পায় তা নিজ ক্ষেত্রে সবার দৃষ্টিতেই নিন্দনীয় ও অবশ্যই বর্জনীয় হওয়া উচিত। চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ৪০-৪৫ বছর আগে বিশেষ করে জশনে জুলুস শুরু হয়। যা ১২ রবিউল আউয়াল বাংলাদেশে -শরীয়তের পরিভাষার ঈদ মনে না করে আভিধানিক অর্থে হলেও - ঈদে মিলাদুন নবী সা পালনকারীরাও গত জীবনে কোনো দিন করতেন না - এই নতুন রীতি চালুর পর মূল জুলুস ছাড়াও দেশে বিভিন্ন দরবার ভিত্তিক জশনে জুলুস নিজ নিজ পীরের ভক্তরা খোলা ওয়াগনে দাঁড় করিয়ে ফুলের মালা গলায় জুলুস অনুষ্ঠিত করে থাকে। এসবের বিষয়ে ঈদে মিলাদের পক্ষের মুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপক বিতর্ক ও মতবিরোধ আছে। হাটহাজারী মাদরাসার বয়সও প্রায় ১৩০ বছরের কাছাকাছি। উত্তর চট্টগ্রামে বিভিন্ন দরবার নিজেদের পদ্ধতিতে ধর্মীয় রীতি সংস্কৃতি পালন করে। হাটহাজারী বড় মাদরাসা ও তার অনুসারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভাবধারায় বিশ্বাসী বহু মানুষ নিজেদের রীতি ও সংস্কৃতিতে জীবন যাপন করেন। তাদের মধ্যকার চিন্তাধারা ও ভাবাদর্শগত বৈচিত্র্য থাকলেও পারস্পরিক সহাবস্থানে কোনো সমস্যা হয় না। অতীতের তুলনায় তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বর্তমানে অনেকাংশে কমেও এসেছে। আকিদা বিশ্বাসগত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তাদের মধ্যে ভিন্নমত প্রায় দেড়শ বছর ধরেই আছে। ইসলামের ফরজ ওয়াজিব ও প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহর ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। কিছু ক্ষেত্রে উৎসব অনুষ্ঠান ও রীতি পদ্ধতি পর্যায়ে বেশ বৈচিত্র্য নিয়েই এ দু’টি ধারা সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে আছে। তত্ত্ব ও কিতাব পর্যায়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণগতভাবে তাদের পারস্পরিক মতানৈক্য একটি গ্রহনযোগ্য বিষয়। এসবই একাডেমিক বিতর্কের মধ্যে পড়ে। কোনো কোনো আলেমের আচরণ, উপস্থাপন ও অঙ্গভঙ্গির কারণে কিতাবী বিষয়গুলো মাঠ পর্যায়ে অনুসারীদের মধ্যে ব্যাপক বিরোধের জন্ম দেয়। যখন এই বিরোধ হিংসা বিদ্বেষের পর্যায়ে চলে যায় কিংবা পরস্পরকে শত্রু মনে করতে শেখায়, তখনই এটি ইসলামের বহু ধিকৃত অনৈক্য ও নিন্দিত ভ্রাতৃঘাতী রূপ নেয়। অথচ জায়েজ, মুবাহ, মুস্তাহাব বিষয়ে ভিন্নমত কাউকেই ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় না। যে মুসলমানেরা হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ অন্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে যুগ যুগ ধরে সম্প্রীতির আবহে বসবাস করতে অভ্যস্ত তাদেরই কোনো কোনো অবুঝ অংশ নিজ মুসলমান ভাইদের কঠিনভাবে শত্রু গণ্য করে। এটি ইসলাম ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। উম্মাহর ঐক্য ও মুসলিম সমাজগাঁথুনির জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। সম্প্রতি হাটহাজারী মাদরাসার সামন দিয়ে জুলুস যাওয়ার সময় কেউ একজন অশোভন ইঙ্গিত করে। এটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নিজ আইডি থেকে একজন এটিকে প্রচারও করে। ফেইসবুক সমাজ একে পুঁজি করে বিষয়টিকে সামাজিক সংকটরূপে বড় করতে চায়। কিছু ঝগড়াটে স্বভাবের মানুষ এ বিষয়ে উস্কানীমূলক স্ট্যাটাস দিয়ে একটি অপ্রীতিকর পরিবেশ তৈরিতে সচেষ্ট হয়। ফেইসবুক যেহেতু বহু মানুষের দৃষ্টিতে পড়ার মতো একটি মাধ্যম, তাই মনে হয় শত বছরের অম্লমধুর বিরোধ ও সহাবস্থান এই বুঝি শেষ হয়ে গেলো। সারা দেশে গুজব ও সমাজ মাধ্যম সমানতালে আগুন লাগানোর চেষ্টা করে। দুই পক্ষের হিসাবেই বহিরাগত কোনো শক্তি এই ঝামেলায় ইন্ধন দেয়। বড় মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আঘাতে জর্জরিত হয়। মেখল গড়দুয়ারা চারিয়া মাদরাসা আক্রান্ত হয়। হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্ররা অধিকাংশই চট্টগ্রামের বাইরের। দেশের বিভিন্ন অন্চল থেকে আগত শিক্ষার্থীরা আল্লাহ ও রাসূল সা এর মেহমান। তারা উত্তর চট্টগ্রামের জনগণের নিকট তাদের পিতা মাতা আত্মীয় পরিজনের আমানত। যতই আহত বা অপমানিত বোধ করুক, তারা মাদরাসায়ই শিক্ষকগণের তত্ত্বাবধানে শান্ত ও সুশৃঙ্খল থাকে। কারণ, এখানে চার পাঁচ হাজার ছাত্র রাজপথ বা এলাকায় মব তৈরি করার কোনো সুযোগ বা সংস্কৃতি চালু নেই। মুরব্বীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে তাদের শান্তিপ্রিয় অবস্থান। বিচ্ছিন্ন কেউ অশান্তি তৈরির জন্য ইশারা ইঙ্গিত বা উস্কানী দিয়ে থাকলে এসবের প্রতিক্রিয়া হয়। সজোরে ডিজে গান বা মিলাদুন্নবী সা এর শান বিরোধী কোনো কথা নিজ থেকে কেউ বন্ধ রাখার কথা বলতে পারে। উৎসবমুখর শোভাযাত্রায় এসবও সাধারণত সহজভাবে না নিয়ে বিরোধ বা চ্যালেঞ্জ হিসাবেই মনে করা হয়। যে জন্য ইট পাটকেলে মাদরাসার স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ব্যক্তিগত কাজে দোকানপাটে ও রাস্তায় থাকা দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। এই প্রথম এমন দিনে এতো শিক্ষার্থী একসাথে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ও রক্তাক্ত হলো। হাটহাজারী মাদরাসার মরহুম মুরব্বীদের কবর ও সংলগ্ন মসজিদের চত্বরে ইট পাটকেল ছোঁড়া হয়। যদিও রবিউল আওয়ালের জুলুস মানুষের প্রতি শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা বিলানোর প্রেরণা নিয়ে হওয়ারই কথা। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য রহমত স্বরূপ নবীজি সা এর প্রেমের বাণী বহনই এই জশনের চেতনা হওয়া দরকার। যেখান থেকে ফুলের পাপড়ি, শিরনি, শরবত বিলানো ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের রেওয়াজ দেশে বিদেশের জশনপন্থীদের মধ্যে চালু রয়েছে। যুগ যুগ ধরে একই রাস্তা দিয়ে জুলুস আসা যাওয়া করে। ফেইসবুকের স্ট্যাটাস ও ছবি প্রচারিত না হলে এবং অবিবেচক লোকজন হাঙ্গামা বাধানোর উদ্দেশ্যে উসকানীমূলক কিছু পোস্ট না করলে এবারের এমন কষ্টের গল্প তৈরি হতো না। এই জায়গায় এসব কর্মসূচিতে কখনোই কিছু হয় না। কেননা, চট্টগ্রামে ভিন্ন ভিন্ন ধারার মুসলমান নিজেদের বৈচিত্র্য নিয়েই সহাবস্থান করে আসছেন। দেখা সাক্ষাৎ, সালাম কালাম, চলাফেরা ও যাবতীয় সমাজবদ্ধতা তাদের মধ্যে চলমান। বিরোধ বৈপরিত্য যা আছে, তা শান্তি বিনষ্টের কারণ নয়। কিতাবী বাহাস, বিতর্ক, জবাব, পাল্টা জবাব যুগ যুগ ধরে চললেও তা মারামারি কাটাকাটি বা দাঙ্গা হাঙ্গামার পর্যায়ে পৌঁছার মতো নয়। সামাজিক মাধ্যম ও গুজবে অনেক সময় সাধারণ জনগণের মতো দায়িত্বশীলরাও প্রভাবিত হন। কিন্তু হাটহাজারীর ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মুরব্বীরা তাদের সহনশীলতা ও দায়িত্ববোধের জন্য মোবারকবাদের হকদার। গুজব অপপ্রচার ও চট্টগ্রামের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে না জানা সারাদেশের মানুষ হাটহাজারী এলাকার দ্বন্দ্ব সংঘাত বিষয়ে ছড়ানো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে যখন কঠিন দুশ্চিন্তায়, তখন উভয়পক্ষের বড়রা এগিয়ে এসে সমস্যার আগুনে পানি ঢেলে দেন। বিশেষ করে মাঠে নিযুক্ত সেনাবাহিনী ও হাটহাজারী প্রশাসন খুবই দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে উভয়পক্ষকে টেবিলে এনে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধান করে। আহত মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সান্ত্বনাসহ চিকিৎসার খোঁজখবর নেয়। ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। পরবর্তী সব অনুষ্ঠানে মসজিদ মাদরাসাকে উচ্চ শব্দ ও অশোভনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্ত রাখার জন্য কিছু নির্দেশনা বেধে দেয়। সবচেয়ে বড় ভূমিকায় ছিলেন উভয়পক্ষের দশজন করে প্রতিনিধি। তারা শান্তি বজায় রাখার মতো মন নিয়ে ধূমায়িত একটি স্ফুলিঙ্গকে শুরুতেই নিভিয়ে দিয়েছেন। তাদেরকে আন্তরিক মোবারকবাদ। বেশ কিছুদিন যাবত দেশে অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে জনজীবন বিপর্যস্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে। হাটহাজারীর বিষয়টি পুঁজি করে সারাদেশে অস্থিরতা তৈরি করার লোকেরও অভাব ছিলনা। এসব জায়গায় বিবেকবান নেতৃবৃন্দের পরিনামদর্শিতা ও সহিষ্ণুতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে ইসলাম ও মুসলমানের দেশী বিদেশী বড় কোনো শত্রুকে সুযোগ দেওয়া যাবে না। মতের বৈচিত্র্য থাকে থাকুক, মনের দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু সংঘাত কিছুতেই কাম্য নয়। ৯২% মুসলমানের স্বাধীন দেশে সব ধর্ম মত ও পথের নাগরিক মিলে পরস্পরের বিশ্বাস আচরণ রীতি সংস্কৃতি নিজেদের মতো করে পালনের মতো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অতীতের মতোই ধরে রাখতে হবে। লেখক: রাষ্ট্রচিন্তক, কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিক এসএকে/ |