বাইতুল্লাহ শরীফে জুমার খুতবা: সত্য মুক্তি দেয়, মিথ্যা ধ্বংস করে
প্রকাশ:
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৭:০২ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
![]()
শায়খ ড. মাহের বিন হামদ আল মুআইকিলি (২০-০৩-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ১২-০৯-২০২৫ ঈসায়ি তারিখে বাইতুল্লাহ শরীফে প্রদত্ত জুমার খুতবা) আমি নিজেকে ও আপনাদেরকে তাকওয়া অবলম্বন করার উপদেশ দিচ্ছি। যে আল্লাহকে ভয় করে, তার চিন্তা-ভাবনা হয় আখিরাত। আর যে আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেয়, আল্লাহ তার অন্তরে তুষ্টি দেন, তার বিচ্ছিন্ন অবস্থা একত্র করেন এবং দুনিয়া নিজে থেকেই তার কাছে চলে আসে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنۡ یَّتَّقِ اللّٰہَ یَجۡعَلۡ لَّہٗ مَخۡرَجًا ۙ وَّیَرۡزُقۡہُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ ইমাম বুখারি রহ. তাঁর সহীহ গ্রন্থে হযরত কাব ইবনে মালিক রা.-এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি তাবুক যুদ্ধ থেকে বিরত ছিলেন। তিনি বলেন, 'যখন শুনলাম, নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ শেষে ফিরে আসছেন, তখন আমার মন দুঃশ্চিন্তায় ভরে গেল। আমি মিথ্যা কোনো অজুহাত দেওয়ার কথা ভেবে দেখছিলাম কীভাবে তাঁর রোষ থেকে বাঁচব? এ ব্যাপারে আমি পরিবারের জ্ঞানীদের সঙ্গেও পরামর্শ করেছিলাম। কিন্তু যখন খবর এলো যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় এসে গেছেন, তখন আমার মন থেকে মিথ্যার চিন্তা চলে গেল। বুঝলাম, মিথ্যার মাধ্যমে আমি কখনোই রক্ষা পেতে পারব না। তাই আমি সত্য বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ভ্রমণ শেষে ফিরে আসতেন, তখন প্রথমে মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন, তারপর মানুষের সঙ্গে বসতেন। আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গেলাম। সালাম দিলে তিনি হালকা হেসে উঠলেন, যেমন রাগের সময় হাসেন। তারপর বললেন, ‘এসো’। আমি গিয়ে তাঁর সামনে বসলাম। তিনি বললেন, ‘তোমাকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে কী নিবৃত্ত রেখেছিল? তুমি কি বাহন প্রস্তুত কর নি?’ আমি বললাম, ‘জি, হে আল্লাহর রাসূল, বাহন তো ছিল। কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি যদি দুনিয়ার অন্য কারো কাছে যেতাম, তবে মিথ্যা বলে হয়ত তাকে খুশি করতে পারতাম। আমি যুক্তি দেখাতে পারি, কিন্তু আপনার কাছে মিথ্যা বলে বাঁচতে চাই না। কারণ যদি আজ আমি মিথ্যা বলি, আপনি হয়ত খুশি হবেন, কিন্তু আল্লাহ আমাকে শিগগিরই ধরবেন। আর যদি সত্য বলি, আপনি রাগ করবেন, কিন্তু আমি আল্লাহর ক্ষমা আশা করব। হে আল্লাহর রাসূল! আমার কোনো অজুহাত নেই। আমি কখনোই এত শক্তিশালী ও সক্ষম ছিলাম না, যতটা তখন ছিলাম যখন আপনার সঙ্গে যাইনি।’ নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এ লোকটি সত্য বলেছে। যাও, আল্লাহ তোমার ব্যাপারে যা ঠিক করেছেন তা-ই হবে।’ পরে আল্লাহ তাআলা হযরত কাব ইবনে মালিক রা. ও তাঁর দুই সাথীর তওবা কবুল করলেন। হযরত কাব রা. মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এলেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হয়ে বললেন, 'তোমার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত এটাই তোমার জীবনের সবচেয়ে উত্তম দিন।' তিনি আরও বলেন, 'আল্লাহর কসম! যেদিন থেকে আমি এ প্রতিজ্ঞা করেছি, এরপর থেকে আর কোনোদিন ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলিনি। আমি আশা করি, আল্লাহ আমায় শেষ পর্যন্ত সত্যবাদিতায় অটল রাখবেন।' এরপর মহান আল্লাহ এই আয়াত নাজিল করলেন, لَقَدۡ تَّابَ اللّٰہُ عَلَی النَّبِیِّ وَالۡمُہٰجِرِیۡنَ وَالۡاَنۡصَارِ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡہُ فِیۡ سَاعَۃِ الۡعُسۡرَۃِ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا کَادَ یَزِیۡغُ قُلُوۡبُ فَرِیۡقٍ مِّنۡہُمۡ ثُمَّ تَابَ عَلَیۡہِمۡ ؕ اِنَّہٗ بِہِمۡ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ ۙ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَکُوۡنُوۡا مَعَ الصّٰدِقِیۡنَ হযরত কাব রা. বললেন, 'ইসলাম পাওয়ার পর আমার কাছে সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হলো, আমি নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সত্য বলেছি। যদি মিথ্যা বলতাম, তাহলে অন্যদের মতো ধ্বংস হয়ে যেতাম।' আল্লাহ তাআলা কাব ইবনে মালিক রা., তাঁর সাথী ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি সন্তুষ্ট হোন। মহান আল্লাহ আমাদেরও তাঁদের সঙ্গে জান্নাতে একত্র করুন, ‘বাগান ও নদীর মধ্যে, সত্যের আসনে, সর্বশক্তিমান বাদশাহর সান্নিধ্যে।’ (সূরা কামার, আয়াত: ৫৪-৫৫) সত্যবাদিতা হলো একজন মুমিনের সবসময়কার পরিচয়চিহ্ন। কথা, কাজ ও ব্যবহারে একজন মুমিন সত্যের ওপর অটল থাকে। ধীরে ধীরে সত্য তার স্বভাব হয়ে যায়, এমনকি কখনোই তা থেকে বিচ্যুত হয় না। সে কোনো কথা অযথা বলে না, মিথ্যা ধারণার ওপর ভিত্তি করে কোনো রায় দেয় না। বরং সত্যকে খোঁজে, চেষ্টা করে সত্যের জন্য, যতক্ষণ না আল্লাহ তার নাম 'চরম সত্যবাদী' হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। এটি এমন এক উচ্চ মর্যাদা, যা নবুয়ত ও শাহাদতের মধ্যে স্থান পেয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ وَالرَّسُوۡلَ فَاُولٰٓئِکَ مَعَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ مِّنَ النَّبِیّٖنَ وَالصِّدِّیۡقِیۡنَ وَالشُّہَدَآءِ وَالصّٰلِحِیۡنَ ۚ وَحَسُنَ اُولٰٓئِکَ رَفِیۡقًا ؕ হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সত্যকে ধারণ করা তোমাদের একান্ত কর্তব্য। কেননা সততা নেক কর্মের দিকে পথপ্রদর্শন করে। আর নেককর্ম জান্নাতের পথপ্রদর্শন করে। কোন ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে ও সত্য বলার চেষ্টায় রত থাকলে, অবশেষে আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। আর তোমরা মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকো! কেননা মিথ্যা পাপের দিকে পথপ্রদর্শন করে। আর পাপ নিশ্চিত জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করে। কোন ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বললে ও মিথ্যার উপর অবিচল থাকার চেষ্টা করলে, অবশেষে সে আল্লাহর নিকট মিথ্যাবাদীরূপে লিপিবদ্ধ হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬৫৩৩) অতএব ধন্য সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর সঙ্গে সত্যবাদী থাকে, আল্লাহও তাকে সম্মানিত করেন। অনুরূপভাবে ধন্য সেই ব্যক্তি, যে মানুষের সঙ্গে সত্যবাদী থাকে, ফলে আল্লাহ তাকে মর্যাদা দেন। ধন্য সেই ব্যক্তি, যে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সত্যবাদীদের পথে অটল থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ رِجَالٌ صَدَقُوۡا مَا عَاہَدُوا اللّٰہَ عَلَیۡہِ ۚ فَمِنۡہُمۡ مَّنۡ قَضٰی نَحۡبَہٗ وَمِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّنۡتَظِرُ ۫ۖ وَمَا بَدَّلُوۡا تَبۡدِیۡلًا ۙ সত্য একটি মহৎ গুণ। আল্লাহ তাআলা নিজেকে সত্যবাদী হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, وَمَنۡ اَصۡدَقُ مِنَ اللّٰہِ قِیۡلًا আর আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো 'সৎ ও আমানতদার' হিসেবে খ্যাত ছিলেন নবুয়ত পাওয়ার আগেই। তিনি সত্যের সঙ্গে এসেছেন, সত্যের কথাই বলেছেন, সত্যের আদেশ দিয়েছেন। তিনি সবচেয়ে সত্য প্রতিশ্রুতিদাতা, সবচেয়ে সত্য চুক্তি রক্ষাকারী। আল্লাহ তাঁকে বাহ্য ও অন্তরে সত্যের সৌন্দর্যে শোভিত করেছেন এবং তাঁকে দোয়া করতে শিখিয়েছেন যে, وَقُلۡ رَّبِّ اَدۡخِلۡنِیۡ مُدۡخَلَ صِدۡقٍ وَّاَخۡرِجۡنِیۡ مُخۡرَجَ صِدۡقٍ وَّاجۡعَلۡ لِّیۡ مِنۡ لَّدُنۡکَ سُلۡطٰنًا نَّصِیۡرًا সত্য হচ্ছে নিয়ত, কথা, কাজ ও অবস্থার ভিত্তি। এটি মনকে শান্তি দেয়, দুশ্চিন্তা দূর করে ও দোয়া কবুলের পথ খুলে দেয়। সত্যবাদী সম্মানিত হয়, আর মিথ্যাবাদী লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। এ কারণেই বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যাকে ঘৃণা করতেন; এমনকি ছোট বিষয়ে শিশুর সঙ্গেও। তিনি শিশুদেরকেও সত্যের অভ্যাস করাতেন, মিথ্যা থেকে দূরে রাখতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের রা. ছোট্ট শিশু ছিলেন। একদিন তাঁর মা তাঁকে ডাকলেন, আর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের ঘরে বসেছিলেন। মা বললেন, 'এদিকে আসো, আমি তোমাকে কিছু দেব।' নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি তাকে কী দিতে চেয়েছিলে?' মা বললেন, 'একটা খেজুর।' বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, أما إنك لو لم تعطيه شيئا كتبت عليك كذبة আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যা থেকে সতর্ক করেছেন, এমনকি যদি তা মজা করার জন্যও হয়। তিনি নিজে পরিবার ও সাহাবীদের সঙ্গে রসিকতা করতেন, কিন্তু কখনো সত্য ছাড়া কিছু বলতেন না। ইমাম আহমাদের মুসনাদে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ويلٌ للذي يُحدِّثُ فيكذِبُ ليُضحِكَ به القومَ، ويلٌ له، ويلٌ لهم যত বড় বিষয়ে মিথ্যা বলা হয়, তার ক্ষতি ও শাস্তিও তত বড় হয়। বিশেষ করে আজকের যুগে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে দ্রুত খবর ছড়িয়ে যায়। অভিযোগ, গুজব বা অপবাদ এক মুহূর্তেই পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, যা সমাজ ও নিরাপত্তার জন্য ভয়ংকর ক্ষতি ডেকে আনে। তাই বুদ্ধিমান মানুষ যেন কখনো শত্রুর হাতিয়ার না হয় এবং সমাজ ও দেশকে ক্ষতির মুখে না ঠেলে দেয়। আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, كفى بالمرء إثما أن يحدث بكل ما سمع অতএব, ভেবে দেখুন, যারা নিজেরাই গুজব বানায় ও মিথ্যা ছড়ায়, তাদের অবস্থা কত ভয়াবহ হবে! আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি স্বপ্নের বর্ণনায় এসেছে, وأما الرجل الذي أتيت عليه يشرشر شدقه إلى قفاه ومنخره إلى قفاه وعينه إلى قفاه فإنه الرجل يغدو من بيته فيكذب الكذبة تبلغ الآفاق মিথ্যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে মিথ্যা বলা। মহান আল্লাহ বলেন, وَیَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ تَرَی الَّذِیۡنَ کَذَبُوۡا عَلَی اللّٰہِ وُجُوۡہُہُمۡ مُّسۡوَدَّۃٌ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَہَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡمُتَکَبِّرِیۡنَ সুতরাং হে আল্লাহর বান্দারা, তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধরো, সত্যকে তোমাদের পোশাক ও অলংকার বানাও এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে সত্যকে মেনে চলো। আল্লাহ তোমাদের অন্তরে তাকওয়া দান করবেন, জীবনের পথে দিশা দেবেন। মনে রেখো, সত্য ও আন্তরিকতা একসঙ্গে থাকে। কিয়ামতের দিন কেবল সত্যবাদীরাই রক্ষা পাবে।আল্লাহ তাআলা বলেন, অনুবাদ: আবদুল কাইয়ুম শেখ এমএইচ/ |