লাখো মুমিনের গর্জনে কেঁপে উঠল সোহরাওয়ার্দীর বাতাস
প্রকাশ:
০৩ মে, ২০২৫, ০৫:৪৩ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
![]()
|| আবিদ সিদ্দিকী || ৩ মে ২০২৫, শনিবার। সকালের বাতাসে যেন অন্যরকম এক সুর। পাখিরা যেন তাকওয়ার ধ্বনি গাইছে, আকাশের রঙও আজ একটু বেশি আধ্যাত্মিক, একটু বেশি ঈমানি। এই দিনে, রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সেই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে উঠেছিল আসমানি আহ্বানে সাড়া দেওয়া লাখো হৃদয়ের ঈমানি মিলনমেলা। ভোরের প্রথম আলো ফোটারও আগে, শহর জেগে ওঠে। পূর্ব থেকে পশ্চিম, দক্ষিণ থেকে উত্তর—বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুসলমানদের একটাই গন্তব্য: সোহরাওয়ার্দী। কেউ ট্রাকে চেপে এসেছে দূর মফস্বল থেকে। কেউ রিকশায় এসেছে সন্তানকে কোলে নিয়ে। কেউ শত কিলোমিটার হেঁটে এসেছে ময়লা পাঞ্জাবিতে, কাঁধে ছোটো ঝুলি, হাতে ওজুতে ভেজা তসবিহ। কেউ এসেছে চুপচাপ—কিন্তু চোখে ছিল বজ্রনির্ঘোষ। এই ভিড় কেবল ভিড় নয়, এই জনস্রোত ছিল একেকটি জাগ্রত আত্মার কণ্ঠধ্বনি। এদিন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রশস্ত প্রাঙ্গণ হল এক জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী। দিগন্তবিস্তৃত আকাশে সূর্য তার গরম স্নেহ ঝরিয়ে দিচ্ছিল, আর নিচে মানব-সমুদ্রে উল্লাসের ঢেউ উঠছিল। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ফাঁকা জায়গা—সবই মানুষের স্রোতের মধ্যে মিশে গেছে। লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে উদ্যান এক মহাসমাবেশে পরিণত হয়েছে, যার গতি, যার আবেগ, যার স্রোত ছিল সীমাহীন। এসব কোনো হুড়োহুড়ি নয়, সকাল ৮টার আগেই মাঠ উপচে পড়ে। কিন্তু মানুষ থামে না। সোহরাওয়ার্দীর চারদিকের গেটগুলো দিয়ে প্রবেশে এত চাপ যে, কেউ কেউ প্রাচীর ডিঙিয়ে মাঠে নামছে। এক বৃদ্ধকে দেখা গেল লাঠি হাতে, পা কাঁপছে, তবু মুখে এক অপার প্রশান্তি—তিনি বললেন, ‘বাবা, মরে গেলে আফসোস থাকত! এই মাহফিলে শরিক না হলে কি আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো যেত?’ কোথাও কেউ পড়ে গেলে, তাকে হাত ধরে তুলে নিচ্ছে অপরিচিত ভাই। কোনো শিশু হারিয়ে গেলে, মাইকে ঘোষণা হচ্ছে—‘আমার ভাইয়ের সন্তান, ওকে কেউ একা ছেড়ে দিয়েন না।’ পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেন আজ একটি পরিবার। গরমের তীব্রতা ছিল অসহনীয়, তবে তার মাঝেও এমন এক অনুভূতি ছিল, যা পৃথিবীর সব কষ্টকে অতিক্রম করেছিল। ঈমানের শক্তি, মুসলিম উম্মাহর একতা এবং দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা যেন একত্রিত হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্লোগানে স্লোগানে, “তাকবির!” আর “الله أكبر!” – এর প্রতিধ্বনি আকাশে প্রতিসরিত হচ্ছিল, যেন গোটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানটি একটি সমুদ্র হয়ে উঠেছিল, যার তীরে দাঁড়িয়ে মানুষ আল্লাহর রাহে একত্রিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তপ্ত রোদে পুড়ছে শরীর — তবু শান্ত, তৃপ্ত হৃদয় সুর্য যতই তীব্র হোক, জনতা নড়ছে না। রোদে পুড়ে যাচ্ছে গায়ের চামড়া, ঘামে ভিজছে কাপড়। কিন্তু কারো মুখে ক্লান্তির ছিটেফোঁটা নেই। বরং তারা যেন আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে। কেউ মাটিতে বসে বক্তব্য শুনছে তনুমনে। কেউ চোখ বন্ধ করে কান পেতে শুনছে বক্তার হৃদয় ছোঁয়া ভাষণ। দেখা যাচ্ছে কেউ গরমে কষ্ট পাচ্ছে- অজ্ঞাত লোকেরা তাকে পানি এনে মুখ ধুয়ে দিচ্ছেন, মাতায় পানি ডেলে বাপ ছেলের মত সেবা করে শান্তি করছিলেন। আর সেই মেডিকেল টিম, যারা মুমূর্ষু অবস্থায় বা অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম যেন একটি জীবনদায়ী উপহার হয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল। গ্লুকোজ, স্যালাইন, প্রাথমিক চিকিৎসা, তরল খাদ্য, পানীয় বস্তু মূহুর্তেই দিচ্ছেন ফ্রিতে। প্রকৃতির ক্ষিপ্রতা, মানুষের ব্যস্ততা, এবং অসহ্য তীব্রতা এই সবকিছুর মাঝেও মৌলত্বের চাহিদা বুঝে বান্দা নিজেও দুআর এক পাত্র হয়ে উঠেছিলাম। মানুষের মাঝে পানি বিতরণ করতে করতে, আমি অনুভব করছিলাম—এটি শুধু শারীরিক সাহায্য নয়, এটি একটি আত্মিক যোগসূত্র, যেখানে আমি আমার খেদমত দ্বারা তাদের হৃদয়ের কাছে পৌঁছাতে পারছিলাম। এ যেন এক ধরনের আত্মত্যাগ, যা শরীরের ক্লান্তি না দেখে, মনোবলকে শক্তিশালী করে তোলে। এই সমাবেশ ছিল শুধুমাত্র এক জায়গায় একত্রিত হওয়া নয়, এটি ছিল এক নতুন ইতিহাসের জন্ম। যেখানে আকাশের নিচে এক স্লোগান, এক ঈমান, এক অঙ্গীকার মানুষের জীবনে চিরকালীন প্রভাব ফেলেছিল। প্রতিটি শব্দ যেন হৃদয়ে আঘাত করে গিয়েছিল, আর প্রতিটি দৃশ্য ছিল আধ্যাত্মিক আলোতে সিক্ত, যা সবার হৃদয়কে এক মহান শিখা দিয়ে আলোকিত করে দিয়েছিল। এই মিলনমেলা ছিল শুধু এক দিনের কথা নয়, তেরোর পরে এটি আরেক নতুন যুগের সূচনা। এক যুগ, যেখানে সকল মানুষ তাদের ঈমানের প্রতি ভালোবাসায় একত্রিত হয়ে, নিজেদের দুনিয়াবি তাগিদ ও চাহিদা থেকে মুক্ত হয়ে এক বিশাল মানবিক শক্তির মধ্যে মিলিত হতে সক্ষম। এই সমাবেশ, এই দিন—ইতিহাসের পাতায় সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে, এবং শতাব্দী পরেও তা মানুষের অন্তরে জীবন্ত থাকবে। আমীরে হেফাজতে ইসলাম আল্লমা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী দা.বা. আহ্বান ও সভাপতিত্বে আজকের সমাবেশের মৌলিক লক্ষ্য ছিল- চার দপা বাস্তবায়ন। প্রায় সকল বক্তার কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল নিম্নের ঐতিহাসিক সে চার দফা। এই দফাগুলোও কোনো কাগজের ভাষায় নয়—ছিল হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা কান্না আর প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি। ১. নারী বিষয়ক কমিশনের ইসলামবিরোধী রিপোর্ট বাতিল। স্লোগান উঠল— ‘নারীর মুক্তি পশ্চিমে নয়, ইসলামে। পাশ্চাত্যের ছলনা ভ্রান্ত। ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না!’ এক বক্তা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘আমরা শাপলার উত্তরসূরি। আমরা শহীদের কসম খেয়ে এসেছি—ইনসাফ না পেলে ফের ঘরে ফিরব না।’ মুহতারাম শাইখ হারুন ইজহার হাফি. সহ কয়েকজনে নবী ফারাবি সহ সকল নবী প্রেমিকদেরও মুক্তি চেয়েছেন, দাবি দিয়েছেন শাতিমে রাসূলের বিচার একমাত্র কতল নিশ্চিত করার। কাদিয়ানিদের কাফের ঘোষণা করার দাবিও করেছেন কয়েকজন বক্তা। সবকিছুর সাথে- স্লোগানে জেগে উঠছিল আকাস-বাতাস, শব্দে কাঁপল পুরো শহর। সেই সকাল থেকে সমাবেশ শেষ অব্দি, সোহরাওয়ার্দীর বাতাস কাঁপছিল শুধু একটা শব্দেরই গর্জনে। সেটি ছিল—‘আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার!’ আজকের এই দিনে ঢাকার বুকে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে লাখো মুসলমান ঘোষণা করেছে -‘আমরা এই দেশে ইসলামের আলো জ্বালাবো। আমরা দীন বিক্রি করবো না, ঈমানকে গাঢ় কালিতে লিখবো সময়ের গায়ে।’ অবশেষে দাবি আদায় না হলে মহাসচিবের ঘোষণায় ক্রমান্বয়ে নতুন কর্মসূচি ও আমীরে হেফাজতের দুআ- মোনাজাতের মাধ্যমে, মুমিনের চোখের পানির বন্যায় জাতীয় মহা সমাবেশ সমাপ্তি ঘটে। অতঃপর বান্দার চোখের পানির সাথে সাথে উত্তপ্ত গরমে পুড়া ঈমানদারের কাফেলার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লাও ঢাকার আকাশ থেকে ঢেলে দিলেন বৃষ্টি নামক প্রশান্তির ঝর্ণা। সুবহানাল্লাহ। এই দিনটি স্বাক্ষর রাখবে ইতিহাসে— যেহেতু এ' দিন অসংখ্য হৃদয় একসাথে আওয়াজ তুলেছিল আল্লাহর নামে, ইসলামের পতাকা তলে। নতুন ইতিহাস লেখা হলো— কলমে নয়, ঈমান, কান্না, তাকওয়া আর দৃঢ়প্রত্যয়ের অশ্রুতে। এই জনতার কান্না কবুল করেন। এই জমায়েতকে হকের দল হিসেবে কবুল করেন। আমাদের শহীদদের রুহানী ঘুম শান্ত করেন। এই দেশে কুরআন-সুন্নাহর বিজয় এনে দেন। আমাদের ঈমানে সাচ্চা শক্তি, প্রবল জোর দান করেন। আমিন।’ লেখক: উস্তাযুল হাদীস, মারকাযুল উলুম আল-মাদানিয়া ঢাকা এমএইচ/ |