তাওহীদ আদনান ইয়াকুব
আমার মনে হয়, কোনো কোনো মানুষকে আমরা কখনো চোখে না দেখেও হৃদয়ে ধারণ করি। তাঁদের প্রতি একটা অনুরাগ জন্ম নেয় শ্রুতির গভীরতা থেকেই। আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ. আমার কাছে তেমন একজন মানুষ ছিলেন—প্রথমে শুধু নামেই পরিচিত, পরে ঘনিষ্ঠ স্মৃতিতে রূপ নেয়া এক ভালোবাসার নাম।
এই নামটি আমি প্রথম শুনেছিলাম আমার শ্রদ্ধেয় পিতার মুখে। বাবা ছিলেন মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের
ফাযেল, চরমোনাই জামিয়ার শাইখুল হাদীস। ছাত্রজীবনের সেই সোনালি দিনেই বাবার সাথে আল্লামা সুলতান
যওক নদভী রহ.-এর সম্পর্ক ছিল গভীর, প্রাণবন্ত ও আন্তরিকতায় পূর্ণ। তাই পরবর্তীতে দুইজনের মাঝে
ছিল পারস্পরিক যাতায়াত, ছিল খাঁটি বন্ধুত্বের উষ্ণতা। বাবার কণ্ঠে যখনই হুজুরের কথা উঠতো, তখন সেটি
থাকতো একরকম মুগ্ধতার আবরণে মোড়ানো। সেই মুগ্ধতা আমার মনেও ঢেউ তোলতো।
এরপর হুজুরের নাম শুনি আমার মামার কাছে। মামা কুয়েতে থাকতেন। ধর্মমন্ত্রণালয়ের জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে আল্লামা নদভী রহ. কুয়েত সফরে গেলে মামার বাসায় অতিথি হতেন। সেই সম্পর্কের টানে একবার মামা দেশে এলে নানা বাড়িতে দাওয়াত করেছিলেন হুজুরকে। তিনি সেখানে এসেছিলেন। সেই মুহূর্তে আমি যদিও সরাসরি উপস্থিত ছিলাম না, তবে এইসব বর্ণনার মাঝে গড়ে উঠতে থাকে আমার নিজের এক আবেগময় সম্পর্ক—ভিন্নধর্মী ভালোবাসায় গড়া এক শ্রদ্ধাভাজন মানুষকে নিয়ে হৃদয়ের
আবেগ।
বাবার সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের ফসলই বলা যায়, আমার মেঝো ভাইকে দারুল মাআরিফে পড়তে পাঠানো
হয়েছিল। সেখানেই আমি প্রথম বুঝতে পারি, সুলতান যওক নদভী নামটি শুধু একজন ব্যক্তির পরিচয় নয়;
বরং সেটি এক চিন্তার, এক সাহিত্যের, এক সৌন্দর্যের প্রতীক। ভাইয়া যখন দারুল মাআরিফে ছিলেন, তখন
সেখানে সুলতান যওক সাহিত্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন ছিল। ভাইয়া সেই পরিষদের পরিচালনা কমিটিতে
ছিলেন—সম্ভবত সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। সেই সুবাদে ভাইয়াকেও খুব আদর স্নেহ করতেন
হুজুর। ভাইয়ার কাছেও হুজুরের বিবরণ শুনে শুনে মুগ্ধ হতাম। বিভিন্ন সময়ে ভাইয়া দারুল মাআরিফের
ম্যাগাজিন নিয়ে আসতেন, সেগুলোতে হুজুরের লেখা বা প্রভাবিত ভাবধারা প্রতিফলিত হতো। আমি তা গভীর
মনোযোগে পড়তাম। মনে হতো, যেনো সাহিত্যের পাতায় এক পবিত্র সুবাস ছড়িয়ে আছে।
২০০৬ সালে আমার বাবা ইন্তেকাল করেন। তাঁর স্মরণে একটি স্মারক প্রকাশের উদ্যোগ নিই আমরা। সেই
সময় আমি সরাসরি গিয়েছিলাম আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ.-এর কাছে, একটি স্মরণিকা-লেখা চাইতে।
তাঁর সাথে সেই সাক্ষাৎ আজও মনে পড়ে পরম শ্রদ্ধায়। হুজুরের আন্তরিকতা, ভালোবাসা, এবং যে
খুলুসিয়্যাত আমি সেদিন কাছ থেকে দেখেছি—তা ভাষায় প্রকাশ করা সহজ নয়। যেনো একজন বড় মানুষ ছোট মানুষদের প্রতি কতখানি স্নেহধর্মী হতে পারেন, তা সেদিন বুঝতে পেরেছি।
আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ. ছিলেন একাধারে বিশুদ্ধ আত্মার মানুষ, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক,
চিন্তাশীল লেখক ও অনুপ্রেরণাদানকারী বুদ্ধিজীবী। সাহিত্য, ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজ ভাবনায় তাঁর
সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের চিন্তা ও চেতনায় আলোড়ন তুলেছে। তাঁর লেখনী ছিল সুরেলা অথচ প্রখর
যুক্তিবোধে ভরপুর। তিনি যে বিষয়েরই ওপর কলম ধরতেন, তাতেই থাকতো গভীরতা, ব্যঞ্জনা ও
আবেগের এক চমৎকার ভারসাম্য।
তিনি কেবল একজন শিক্ষাবিদই ছিলেন না, ছিলেন সাহিত্যিকতার ময়দানে নেতৃত্বের এক মূর্ত প্রতীক। তাঁর
চিন্তা ও লেখনিতে আমরা দেখতে পাই ইসলামি ভাবধারার এক সুসংহত রূপ, যা আক্বীদা, আদর্শ, ইতিহাস
এবং বাস্তবতার মাঝে একটি ভারসাম্য গড়ে তোলে। তাঁর সাহিত্যপ্রেম ও শব্দচয়ন ছিল মার্জিত, পরিমিত ও
চিত্তাকর্ষক। বাংলা-উর্দু-আরবি সাহিত্যচর্চায় তাঁর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়।
তাঁর মধ্যে যে অজস্র গুণ ছিল, তার অন্যতম ছিল বিনয়। নিজেকে কখনো সামনে আনতেন না, অথচ তাঁর
আলো ছড়িয়ে যেতো নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থে। তিনি ছিলেন সেই ধরনের মানুষ, যিনি একবার কারো জীবনে
প্রবেশ করলে স্মৃতিতে থেকে যান চিরদিনের জন্য। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর স্মৃতি, তাঁর
লিখনভঙ্গি, তাঁর মুখাবয়বের প্রশান্তি, তাঁর সদালাপি মেজাজ, তাঁর কলমের ধ্বনি—সবকিছু যেনো আজো কোথাও এক কোমল বাতাস হয়ে আমার হৃদয় স্পর্শ করে যায়।
اللهم اغفر له وارحمه وعافه واعف عنه، واجعل قبره روضة من رياض الجنة
“হে আল্লাহ! তাঁকে মাগফিরাত দান করুন, দয়া করুন, তার উপর শান্তি বর্ষিত করুন এবং তাঁর কবরকে
জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দিন।” আমীন।
এমএইচ/