জোরালো হচ্ছে শরিয়া আদালত প্রতিষ্ঠার দাবি
প্রকাশ: ২২ মে, ২০২৫, ১২:১১ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

শাব্বির আহমাদ খান

বাংলাদেশে মুসলিম জনসংখ্যার হার নব্বই শতাংশের ওপরে। অথচ আজও এ দেশের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে উপনিবেশিক ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী। আলেম-উলামাদের পক্ষ থেকে প্রায়ই এই প্রশ্নটি উত্থাপন হয় যে, কোন যুক্তিতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো একটি খ্রিস্টান-ইহুদি প্রভাবিত আইনি কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হবে?

সম্প্রতি দেশের প্রথিতযশা আলেমদের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে দাবি উঠেছে—বাংলাদেশে মুসলমানদের জন্য কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র শরিয়া আদালত গঠন করতে হবে। তারা বলছেন- পারিবারিক, উত্তরাধিকার, বিবাহ-বিচ্ছেদ ও সম্পত্তিসংক্রান্ত বিষয়গুলো ব্রিটিশ আইনে নয়, বরং শরিয়া অনুযায়ী পরিচালিত হওয়াই ন্যায্য ও সংবেদনশীল পন্থা। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে এর নজির রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা।

এই প্রেক্ষাপটে আমরা কথা বলেছি দুজন বিশিষ্ট তরুণ আলেমের সঙ্গে, যাঁরা শরিয়া আদালতের প্রয়োজনীয়তা, বাস্তবতা এবং সম্ভাব্য কাঠামো নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন।

আরবি ভাষাবিদ ও মাদরাসা পরিচালক শায়খ মহিউদ্দীন ফারুকী শরিয়া আদালত প্রতিষ্ঠার দাবিকে ‘সম্পূর্ণ যৌক্তিক ও সময়োপযোগী’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, আমার জীবনের প্রতিটি দিক, বিশেষত বিচার ব্যবস্থাপনা, ইসলামি শরিয়ার আলোকে পরিচালিত হলে তাতে প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। শরিয়া শুধু একটি আইন নয়, এটি ইনসাফ ও ন্যায্যতার পূর্ণ প্রতিফলন।’

বিশেষজ্ঞ এই আলেম বলেন, ‘আজ যারা শরিয়া আদালতের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদের অনেকেরই সমাজে বিশেষ কোনো গ্রহণযোগ্যতা বা জনসমর্থন নেই। অথচ তারাও নিজেদের জন্য পশ্চিমা ধাঁচের আইন বা ভিন্ন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দাবি জানিয়ে থাকেন। তাহলে দেশের ৮৫ শতাংশ মুসলমান, যারা ইসলামি জীবনব্যবস্থায় বিশ্বাসী, তারা কেন শরিয়া আদালতের দাবি জানাতে পারবে না?’

শায়খ ফারুকী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই বহু জটিল ও কঠিন কাজকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছি। সুতরাং, উপযুক্ত পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরিয়া আদালত বাস্তবায়ন করাও সম্ভব। বিশ্বের যেসব দেশে শরিয়া আদালত সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলোকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে।’

তিনি শরিয়া আদালত গঠনের কাঠামো নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা দেন। তার ভাষায়, ‘যেমন দেশের প্রচলিত আদালতের বিভিন্ন স্তর ও তহবিল আছে, তেমনি শরিয়া আদালতও একটি পৃথক স্তরে সংযুক্ত করা যেতে পারে। এই আদালতের দায়িত্বে থাকবেন ইসলামি শরিয়া বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত আলেম, স্কলার ও মুফতিরা। যারা দেশি ও আন্তর্জাতিক মানের ইসলামিক প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাদেরকে বাছাই করে শরিয়া কোর্টে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। একইসঙ্গে দেশের স্বনামধন্য ফতোয়া বিভাগ থেকে পাসকৃত মুফতিদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শরিয়া আদালতে সম্পৃক্ত করা সম্ভব।’

মহিউদ্দীন ফারুকী বলেন, ‘এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে একটি শরিয়া বোর্ড গঠন করতে হবে, যেখানে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল থাকবে। এই প্যানেলের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে শরিয়া আদালত পরিচালিত হবে। শরিয়া আইন কেবল শাস্তির জন্য নয়, বরং মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যই নির্ধারিত। আমরা আশাবাদী—শরিয়া আদালত গঠন করতে পারলে সমাজে প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে এবং মানুষ এর সুফল ভোগ করবে।’

জাতীয় উলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুফতি রেজাউল করীম আবরার আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘বাংলাদেশে পৃথক শরিয়া আদালত গঠন করা সম্পূর্ণ সম্ভব—আমি একে কখনোই অসম্ভব মনে করি না। আমাদের দেশে রয়েছে বহু জ্ঞানী ফকিহ ও মুহাদ্দিস, যারা দেশি-বিদেশি উচ্চতর ডিগ্রিধারী এবং ইসলামি আইন বিষয়ে সুগভীর জ্ঞান রাখেন। তাদের তত্ত্বাবধানে একটি শরিয়া আদালত পরিচালনা করা যেমন সহজ, তেমনি বাস্তবসম্মত।’

তাঁর মতে, এই আদালতের মাধ্যমে যদি শরিয়া অনুযায়ী শাস্তি কার্যকর করা যায়, তাহলে দেশে অপরাধ প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে। বর্তমানে অপরাধ কম না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো—বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতা এবং শাস্তি কার্যকর না হওয়া।

বিশিষ্ট এই আলেম বলেন, ‘আমরা জোর দাবি জানাই—দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও অভিজ্ঞ ফকিহদের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র শরিয়া কোর্ট গঠন করা হোক, যা ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’

এনএইচ/