একই দিনে ‘ঈদ পার্টির’ যে প্রশ্ন কমন পড়েনি!
প্রকাশ: ২৬ জুন, ২০২৫, ১১:৩৬ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

।। মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী।।

মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসারকে অহেতুক দোষারোপ না করে সঠিক ঘটনা জানুন। চান্দ্রমাসের সঠিক তারিখ বাস্তবায়ন কমিটি নামে একটি ভূঁইফোড় সংগঠন আছে। যাদের কাজ হলো: সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ ও রোজা করা বিষয়ে ফিতনাবাজি করে বেড়ানো।

তাদের মহাসচিব জনাব রফীকুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে গত ২৪ জুন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ইউএনও মহোদয়ের অফিসে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

এতে আমি লুৎফুর রহমান ফরায়েজীসহ লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়ার সম্মানিত শিক্ষক মুফতী যুবাযের বিন আব্দুল কুদ্দুস ও মুফতী সাইফুল্লাহ হাবীবী এবং বরিশালের মাওলানা আবুল কালাম অংশগ্রহণ করি।

বিতর্কের শুরুতেই আমি তাদের একটি প্রশ্ন করি: আপনারা বিশ্বের যেকোনো স্থানে চাঁদ দেখা গেলে সারা বিশ্বে ঈদ ও রোজা রাখা ফরজ হয়ে যাবার কথা বলে থাকেন। আর রোজা রাখার কথা বলেন, সুবহে সাদিকের সময় থেকে। সুতরাং সুবহে সাদিকের আগে চাঁদ ওঠার সংবাদ পেলে তাদের ওপর রোজা রাখা আবশ্যক হয়ে যায়।

তো আমার জানার বিষয় হলো: যদি সৌদিতে চাঁদ দেখা যায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। সেই হিসেবে সৌদিবাসী রোজা রাখবে বুধবার। কিন্তু এই চাঁদের সংবাদ নির্ভরযোগ্য পন্থায় আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে যদি তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যায়, তাহলে তাদের তখন সোমবার শেষ রাতের ৪টা বাজে।

আর ২৪ জুনে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে সাহরির শেষ সময় হলো ৪টা ৩৪ মিনিট। এর মানে তারা আধা ঘণ্টা সময় পাচ্ছেন সাহরি খাওয়ার। এখন আমার জানার বিষয় হলো: সৌদির চাঁদ দেখা অনুযায়ী কি হাওয়াইবাসী রোজা রাখবে? নাকি সেদিন চাঁদের সংবাদ পাবার পরও তারা পুরো একদিন অতিক্রান্ত করে পরদিন রোজা রাখবে?

সম্পূরক প্রশ্ন হলো: যদি বলেন রোজা রাখবে, কারণ, তাদের কাছে সাহরির সময় শেষ হবার আগেই  চাঁদের সংবাদ এসেছে। তাহলে হাওয়াইবাসীর রোজা শুরু হবে মঙ্গলবার থেকে। আর সৌদিবাসী যেহেতু মঙ্গলবার চাঁদ দেখেছে তাই তাদের রোজা শুরু হবে বুধবার থেকে। তাহলে দুই দেশে একই দিবসে রোজা হলো কীভাবে?

আর যদি বলেন যে, তারা রোজা রাখবে না, বরং একদিন অতিক্রান্ত করে পরদিন তথা বুধবার রোজা রাখবে। যদি তাই বলেন, তাহলে সৌদির চাঁদ দেখার সংবাদ তারা পাবার দ্বারা তাদের লাভ কী হলো? কারণ তারাতো মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এমনিতেই চাঁদ দেখবে। দ্বিতীয়ত এভাবে সাহরির সময়ের আগে রোজার চাঁদের সংবাদ পাবার পরও সেদিন রোজা না রেখে আরেক দেশের সাথে মিলানোর জন্য একদিন পর থেকে রোজা শুরু করা কুরআনের কোন আয়াত বা কোন হাদিসের দ্বারা প্রমাণিত তা একটু জানাবেন।

আমাদের এই এক প্রশ্নই তাদের সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ ও রোজা করার ভুয়া দাবির দালান ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। বেচারা মহাসচিব রফীকুল ইসলাম সাহেব তখন বিশাল ওয়াজ করলেন, কিন্তু প্রশ্নের উত্তরের কাছেও গেলেন না।

আমি তখন স্মরণ করিয়ে দিলাম: আপনি মনে হয় আমাদের প্রশ্ন বুঝেননি।

তিনি বললেন, বুঝছি।

বললাম, তাহলে উত্তর না দিয়ে অন্য দিকে ঘুরতেছেন কেন?

এবার বলতে লাগলেন, যদি মঙ্গলবার চাঁদ দেখা যায়, তাহলে অন্যান্য দেশে যেই সময় মঙ্গলবার আসবে সেদিনই তাদের ওপর রোজা রাখা ফরজ হবে। এর আগে ফরজ হবে না।

আমি বললাম: তাহলে চাঁদ দেখার সংবাদ সাহরির সময়ের আগে পাওয়ার পরও একদিন রোজা ছাড়া থাকা কোন আয়াত বা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত একটু দেখান।

বেচারা বারবার পানি খায়। আর পানি খায়। কিন্তু উত্তর আর খুঁজে পায় না।

মাঝখান থেকে তাদের একজন বলে উঠলেন: আপনি খালি সৌদির চাঁদের কথা বলেন কেন? আমরা বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের কথা বলেন। আমাদের কথা হলো: যেকোনো দেশে চাঁদ উঠলেই সারা বিশ্বে সেই চাঁদ অনুপাতে আমল করতে হবে।

আমি বললাম: ‘আচ্ছা ঠিক আছে, বাংলাদেশের কথা বলি। যেহেতু যেকোনো দেশে চাঁদ উঠলেই সেই চাঁদ অনুপাতে ঈদ রোজা রাখা সব দেশের মানুষের ওপর আবশ্যক হয়।

তাহলে আমার প্রশ্ন হলো: আজ মঙ্গলবার আমাদের বাংলাদেশে যখন দুপুর ১১টা। তখন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে গতকাল তথা সোমবারের সন্ধ্যা। যদি তারা সোমবার সন্ধ্যায় রোযার চাঁদ দেখে, সেই হিসেবে তারা মঙ্গলবার রোজা রাখবে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে হাওয়াইবাসীর চাঁদের সংবাদ তৎক্ষণাৎ ইন্টারনেট বা রেডিও টিভির মাধ্যমে যখন এলো তখনতো আমাদের মঙ্গলবারের দুপুর এগারোটা। এখন আমরা কী করবো? আমরাতো মঙ্গলবার রোজা রাখার কোনো সুযোগ নেই। দুপুর এগারোটা থেকে কীভাবে রোজা হবে? সুতরাং আমরাতো রোজা রাখবো বুধবার। তাহলে হাওয়াবাসীর চাঁদ দিয়ে আমরা কীভাবে একই দিনে রোজা ও ঈদ করবো?

এ প্রশ্ন ছিল তাদের ভণ্ডামির ওপর সর্বশেষ পেরেক। বেচারা রফীকুল ইসলাম এবার বলেন- আমরা কিতাব থেকে বলি বলেই অনেক্ষণ এদিকে সেদিক বক্তব্য দিলেন।

তারপর আরেকজন দাঁড়িয়ে কিতাব খুলে অপ্রাসঙ্গিক আলাপ করলেন। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরের কাছাকাছিও কেউ গেলেন না।

আমরা একজন কথা বলার পরও তাদের দুইজনের বক্তব্যের পরও যখন উত্তর দিতে পারছিল না। তখন নির্বাহী অফিসার বেশ বিরক্ত হচ্ছিলেন।

এবার তাদের তৃতীয় আরেকজন দাঁড়িয়ে কথা বলতে চাইলেন।

ইউএনও সাহেব তাকে নিবৃত করার চেষ্টা করলেন।

কিন্তু বেচারা হেরে যাওয়ায় এক প্রকার উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করে দেন।

এতে ইউএনও সাহেবর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। তিনি ধমক দিয়ে বলেন, ‘চুপ হোন। নিজেকে বড় আলেম মনে করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন যে ফায়সালা দেয় এটাই চূড়ান্ত। আপনারা বের হোন। আপনারা সবাই বেরিয়ে যান।’

এই হলো ঘটনা। এখানে অনেকেই ইউএনও সাহেবের ধমককে ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা করছেন। অথচ এখানে ইউএনও সাহেবের কোনো দোষ নেই। তারা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না। দুইজনে পারেনি। এখন আরেকজন বলতে চাচ্ছে। অথচ নিয়ম মাফিক এক পক্ষে একজন বলার পর অপরপক্ষ থেকে আরেকজন কথা বলবে। কিন্তু আমাদের একজন কথা বলার তাদের পরপর দুইজনকে কথা বলার সুযোগ দেবার পরও সঠিক উত্তর না দিয়ে এদিক সেদিক কথা বলে সময় ক্ষেপণ করার পর তৃতীয় আরেকজন কথা বলতে চাওয়ার অন্যায় আবদারে তিনি প্রথমে শান্তভাবে বলার পরও বাড়াবাড়ি করায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছেন।

সুতরাং মূল ঘটনা না জেনে এভাবে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসারকে দোষারোপ করে নিজের গোনাহের বোঝা ভারী করবেন না।

আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে এভাবেই বাতিলকে লজ্জিত ও অপদস্ত করে থাকেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের হকের ওপর অটল ও অবিচল থেকে তার প্রিয়ভাজন হয়ে কবরে যাবার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা

এনএইচ/