কওমির সরকারি মূল্যায়নকে সমাধান না ভেবে সেলফ স্কিল অর্জন করুন 
প্রকাশ: ২৭ জুন, ২০২৫, ০৫:৪২ বিকাল
এম. মোশাররফ হোসাইন

|| আবদুল্লাহ আল মাসউদ ||

'হজরত, আপনারা কওমি মাদরাসা সনদ নিয়ে কোনো কথাবার্তা একটু বইলেন। আমরা পড়াশোনা করছি বাট সরকারি কোনো জায়গায় কেন মূল্যায়ন নাই।'  ইনবক্সে একজন এই মেসেজটা করল। মনে হলো, এই বিষয়ে কয়েকটা কথা বলি-
যারা দাওরা হাদিসের ক্লাস শুরু করে বা ফারেগ হয়ে তাখাসসুসাতে ভর্তি হয়, তাদের বড় একটা অংশের মধ্যেই দুশ্চিন্তা আর নানান টেনশন ভর করতে শুরু করে। সামনে কী করবে, কীভাবে কী হবে এসব চিন্তা কমবেশ সবাইকেই স্পর্শ করে। আমি নিজেও এই সময়টা পাড়ি দিয়ে এসেছি।

কওমি মাদরাসার পড়াশোনার সরকারি কোনো মূল্যায়ন নেই। স্বীকৃতির পরিবর্তে মূল্যায়ন শব্দটা সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি। কারণ স্বীকৃতি নামক মুলা আছে, তবে এর কোনো কার্যকারিতা নেই। ফলে এই পড়াশোনা দিয়ে সরকারি চাকরির রাস্তা বন্ধ।

এই সময়টাতে অনেক ছাত্রভাই মনে করে সরকারি স্বীকৃতির বাস্তবায়ন হলেই বোধহয় টেনশনমুক্ত হওয়া যাবে। এটা ভুল ধারণা। কয়েকটা কারণে- 
প্রতি বছর যে পরিমাণ ছেলে ফারেগ হয় তার তুলনায় সরকারি চাকরির কোটা খুবই সামান্য। তার মানে শতকরা হয়ত ৫% বা ১০% সমাধান হবে। সরকারি মূল্যায়নের ফলে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও মূল্যায়ন করবে। সেখান থেকে হয়ত আরও ১০% সমস্যার সমাধান হবে। 

সংখ্যাটা কম ধরছি এজন্য যে, আমাদের যে সিলেবাস ও যে ধরনের পড়ালেখা, সেটা দিয়ে ধর্মীয় প্রফেশনের বাইরে অন্য অফিসিয়ালি কাজকর্মের জন্য কেউ নিয়োগ দেবে না বললেই চলে। সেই যোগ্যতাও সাধারণভাবে হয়ে ওঠে না। (কেউ ব্যক্তিগতভাবে অর্জন করলে সেটা ভিন্ন কথা।) 

ফলে সরকারি মূল্যায়ন কিছুটা সমাধান হলেও শতভাগ সমাধান না। আসলে সরকারি চাকরি তো খোদ সরকারি কলেজ-ভার্সিটির ক্ষেত্রেও শতভাগ সমাধান না। হ্যা, তাদের ক্ষেত্রে সমাধানের হারটা অনেক বেশি। কিন্তু শতভাগ না। ভার্সিটিতে পড়ার পর সবাই যে সরকারি চাকরি পায় সেরকম না। কেউ প্রাইভেট জব করে, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে যায়। কেউ অন্য কিছু করে। বুঝাতে চাচ্ছি, এটা আলাদীনের চেরাগ না যে, সরকারি মূল্যায়ন হয়ে গেলেই সব সমাধান হয়ে যাবে। (মূল্যায়ন হোক, এটা অবশ্যয়ই চাই। এটাকে ছোট করে দেখছি না। শুধু বোঝাতে চাচ্ছি, এটাই সমস্যার একমাত্র সমাধান- বিষয়টা তা নয়।) 

তাই, মাদরাসাপড়ুয়া ভাইদের বলব, সরকারি মূল্যায়নকে একমাত্র সমাধান না ভেবে এটার জন্য চেষ্টা ও দাবি তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন সেলফ স্কিল অর্জনের দিকে মনোযোগ দিন। শিক্ষাজীবনে যতভাবে পারে যায় শেখার পেছেন নিজেকে উজাড় করে দিন। নিজের ইলমি পোক্তেগির জন্য আরবি তো ভালো পারতেই হবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এর বাইরে ইংরেজিটা ভালো করে শিখুন। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট এগুলোতে দক্ষ হন। ডিজাইন, এডিটিং কিংবা বিভিন্ন প্রোগ্রামিং শিখুন। জাস্ট কোনো মতে চালাতে পারেন, এমন না। একেবারে প্রো লেভেলে চলে যান। অথবা অন্য কোনো কারিগরি দক্ষতা অর্জন করুন। মানে, যার যেটা সুবিধা যা পারেন ভালোভাবে শিখুন। নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলুন। আগামীর দুনিয়া চাকরির চেয়েও অনেক বড় কিছু হতে যাচ্ছে। যাচ্ছে না, বরং অলরেডি হয়ে গেছে। 

মাদরাসায় যারা পড়ে, সবাই যে মাদরাসাতেই চাকরি করে এমন না। এটা বাস্তবতার আলোকে সম্ভবও না। অনেকেই অনেক পেশায় চলে যায়। অন্য পেশায় যেহেতু যাবেনই, সেটা যেন ভালো কিছু হয়। আপনার রাস্তা আপনাকেই তৈরি করতে হবে। অন্য কেউ রাস্তা তৈরি করে রাখবে আর আপনি রাজার হালে হেঁটে যাবেন সেখান দিয়ে, দুনিয়াটা এত সহজ না। শুরুতে অনেক সংগ্রাম থাকবে, কষ্ট থাকবে। মিনিমাম ৩ বছর ধরে রাখেন এই সময়কাল। এরপর আস্তে আস্তে মেঘ কেটে যাবে এবং জীবন আকাশে সূর্যের হাসি দেখবেন ইনশাআল্লাহ। যেহেতু সরকারি মূল্যায়ন হচ্ছে না, আর আদৌ হবে কি না আল্লাহ মালুম, হলেও সেটা খুব অল্পসংখ্যকের জন্য সমাধান হবে, তাই এছাড়া কোনো পথ দেখছি না। 

হ্যাঁ, এমন কিছু আত্মত্যাগী মানুষও এখানে লাগবে, যারা নিজেকে ইলমের জন্য সঁপে দেবে। সীমিত উপার্জনে অল্পতুষ্টির মাধ্যমে কুরবানির সর্বোচ্চ নজরানা পেশ করে মাদরাসাগুলোকে টিকিয়ে রাখবে। তাদের মর্যাদা অবশ্যই আল্লাহর দরবারে অনেক অনেক বেশি হবে। এটার প্রতিদানও তারা পাবে কয়েকগুণ করে ইনশাআল্লাহ। এমন মানুষদের প্রতি আমার ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সীমাহীন সম্মান রইল।

লেখক: মাদরাসা শিক্ষক, লেখক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট

এসএকে/