বিরে গারস: যেখানে জড়িয়ে আছে নবীজির শেষ ইচ্ছা
প্রকাশ: ৩০ জুলাই, ২০২৫, ০৭:৫১ সকাল
নিউজ ডেস্ক

মাওলানা ফরহাদ হুসাইন

পৃথিবীতে এমন কিছু স্থান আছে, যেগুলোর প্রতি ভালোবাসা জন্মায় হৃদয়ের গহীন থেকে। এমন স্থানগুলো শুধু পাথর-নির্মিত বা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ কিছু নয়, তারা হয়ে ওঠে আত্মার অংশ। ঠিক যেমন এই কুয়াটি। বিরে গারস এক নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মদিনার বুকে, চুপচাপ বহন করছে প্রিয় নবীজি সা.-এর ভালোবাসা, তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো।

এটা সেই কুয়া, যার পানির স্বাদ নিজ হাতে যাচাই করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সা.। যে কুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি দোয়া করেছিলেন, বারাকাহ চেয়েছিলেন। আর এই কুয়ার পানিই ছিল তাঁর পছন্দের। তাঁর মৃত্যুর পরও এই পানি দিয়ে তাঁর পবিত্র দেহ মোবারক গোসল করানো হয়েছিল।

قال رسول الله ﷺ: نعم البئر بئر غرس هي من عيون الجنة وماؤها أطيب الماء.

বিরে গারস একটি উৎকৃষ্ট কুয়া। এটি জান্নাতের ঝরনাগুলোর একটি এবং এর পানি সর্বাধিক উৎকৃষ্ট

(মাজমাউয যাওয়ায়িদ ৩/২৮৬ ,জামে আস-সগীর হাদীস ৭৮৯২; আলবানী সহীহ বলেছেন)।

বিরে গারস শুধু একটি কুয়া নয় এটি ইসলামের জীবন্ত ইতিহাস। বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ সা. এই কুয়ার পানি পান করেছেন এবং এর জন্য দোয়া করেছেন। এমনকি তিনি বলেছেন—

لقد رأيت الليلة كأني على بئر من بئر الجنة.

আমি রাতে স্বপ্নে দেখেছি যেন আমি জান্নাতের এক কুয়ার উপর অবস্থান করছি (মুসনাদে আহমদ হাদীস ১১৫৮২,সুনান ইবন মাজাহ হাদীস ১০৪)।

আনাস রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সা. বিরে গারস কুয়ার পানি দিয়ে অজু করেন এবং অবশিষ্ট পানি কুয়ার ভেতর ঢেলে দেন। এর পর থেকে কুয়ার পানি আর কখনো শুকায়নি(তাবাকাত ইবন সা’দ, তারিখ মদীনা ইবন শাব্বাহ)।

রাসূল সা. তাঁর মৃত্যুর সময় হযরত আলী রাঃ কে وصية করেন যে,

قال علي رضي الله عنه: قال رسول الله ﷺ: "اغسلوني بسبع قرب من بئر غرس.

হযরত আলী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: ‘আমাকে গোসল করাও বিরে গারস কুয়ার পানি দিয়ে, সাতটি চৌবাচ্চা (মশক) দিয়ে।’ (মুসনাদ আহমদ ৮৩৪, সহীহ ইবন হিব্বান ৬৬৪৯,তাবাকাত ইবন সা’দ)।

তাঁর নির্দেশ অনুসারে, হযরত আলী রা.,আব্বাস রা. ও ফাযল ইবনে আব্বাস রা. মিলে সেই পানি দিয়ে নবীজির পবিত্র দেহ মোবারক গোসল করান। এই ঘটনাগুলো কুয়াটিকে শুধু একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন বানায়নি, বরং এক আত্মিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।

বিরে গারস অবস্থিত মদীনা মুনাওয়ারার একটি প্রাচীন ও পবিত্র এলাকা আল-আওয়ালী-তে, মসজিদে নববীর দক্ষিণে মাত্র ১৫০০ মিটার দূরে। কুয়াটি নির্মাণ করেছিলেন মালিক ইবনু নুহাত, যিনি ছিলেন বিখ্যাত সাহাবি সা’দ ইবন খাইথামা রা. এর দাদা। আর এই সা’দের ঘরেই মদীনায় হিজরতের পরে প্রথম অবস্থান করেছিলেন নবীজী সা.।

সম্প্রতি সৌদি কর্তৃপক্ষ কুয়াটি নতুন করে সংস্কার ও উন্নয়ন করেছে। এর চারপাশ পাকা করে, লোহার নিরাপত্তা দেয়াল বসানো হয়েছে। পাশে একটি ছোট মসজিদ স্থাপন করা হয়েছে। কুয়ার পানি পুনরায় প্রবাহিত করা হয়েছে যাতে আগত যাত্রীরা ঐতিহ্যবাহী বারাকাহপূর্ণ পানি পান করতে পারেন।এই প্রকল্পটি পরিচালনা করেন মদীনা অঞ্চলের আমির, প্রিন্স ফয়সাল বিন সালমান আল সৌদ। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে আরও ৮টি প্রাচীন মসজিদ ও স্থান পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শুধু ইতিহাস সংরক্ষণই নয়, বরং নবীজির স্মৃতি ও জীবনের ছোঁয়া বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক অভূতপূর্ব প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।

যখন কোনো হাজী বা উমরাহযাত্রী বিরে গারস কুয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়, তখন তার হৃদয়ে একটি অনির্বচনীয় আবেগ জাগে। কুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করলে মনে হয় যেন নবীজির যুগে ফিরে গিয়েছি। চারপাশে পাহাড়ি পাথরের দেয়াল, বাতাসে মিশে থাকা ইতিহাসের ঘ্রাণ, আর সেদিনকার বারাকাহপূর্ণ পানি—এ সবই মিলে বানিয়ে তোলে এক অনন্য আত্মিক অনুভব।

এই কুয়ার পানি অনেকে সাথে করে নিয়ে যায়, কিছু পান করেন, কিছু ভাগ করেন প্রিয়জনদের সাথে। অনেকে চোখ বন্ধ করে কল্পনা করেন—এই পানির ছোঁয়া হয়তো কোনো একদিন নবীজির ঠোঁটে লেগেছিল, হয়তো তিনি এখানেই বসে দোয়া করেছিলেন তাঁর উম্মতের জন্য।

নবীজি সা.-এর জীবন ছিল সহজ, সরল ও পানির মতো স্বচ্ছ। বিরে গারস সেই সরলতার এক নিদর্শন।যেসব স্থান নবীজির সঙ্গে সম্পর্কিত, সেগুলোর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের অংশ।একটি কুয়া, যা অন্যদের চোখে সাধারণ, উম্মতের কাছে তা জান্নাতের এক অংশ। প্রতিটি পাথর, প্রতিটি ফোঁটা পানি নবুয়তের ইতিহাস বহন করে।

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: نعم البئر بئر غرس، هي من عيون الجنة، وماؤها أطيب الماء.

বিরে গারস একটি উৎকৃষ্ট কুয়া। এটি জান্নাতের ঝরনাগুলোর একটি এবং এর পানি হলো সর্বাধিক উৎকৃষ্ট (আত-তাবাকাত ইবন সা’দ,মাজমাউয যাওয়ায়িদ, মুসতাদরাক হাকিম)।

আজ যখন আমি হেঁটে গেলাম কুয়ার পাশ দিয়ে, মনে হচ্ছিল এই পথের ধূলিকণার মধ্যেও যেন রহমতের সুবাস লুকানো। নবীজির ভালোবাসায় মোড়ানো এই কুয়াটি যেন বলে যাচ্ছিল—

‘আমি শুধু একটি কুয়া নই, আমি এক উম্মতের ভালোবাসার সাক্ষী।’

শিক্ষার্থী : আল-কুরআন ও ইসলামিক স্টাডিজ (স্নাতক - অনার্স)

দ্য কলেজ অফ দ্য প্রফেটস মসজিদ,মদীনা,সৌদি আরব।

এনএইচ/