|| মুফতি ওমর ফারুক ইমতিয়াজ কাসেমী ||
গ্রন্থাগার হচ্ছে একটি জাতির চিন্তাশীলতা ও সভ্যতার দর্পণ। বই মানুষকে যেমন আলোকিত করে, তেমনি গ্রন্থাগার গোটা জাতিকে করে প্রাজ্ঞ ও বিকশিত। আর যদি তা হয় দারুল উলুম দেওবন্দের মতো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার, তবে তা নিঃসন্দেহে ইসলামী জ্ঞানের এক অতুলনীয় ভাণ্ডার।
এই লাইব্রেরি শুধু কিতাবের সংগ্রহস্থল নয়; বরং এটি এক চলমান রূহানী ও গবেষণামূলক আন্দোলনের নাম, যা গত দেড় শতাব্দী ধরে মুসলিম উম্মাহকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে চলেছে।
ঐতিহাসিক পটভূমি: জন্মলগ্নের পেছনের প্রেরণা
১৮৬৬ সাল— উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কঠিন সময়। ঠিক তখনই কিছু আলেম-রাব্বানী, বিশেষত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.)-এর দূরদর্শী নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ।
প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়েই এর উদ্যোক্তারা উপলব্ধি করেন—শিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হতে হলে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার অপরিহার্য। এই উপলব্ধি থেকেই গড়ে ওঠে দেওবন্দের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, যার সূচনা হয়েছিল হাতে লেখা কয়েকটি পাণ্ডুলিপি দিয়ে। আজ তা রূপ নিয়েছে বিশাল, দুর্লভ ও প্রাচীনতম ইসলামি জ্ঞানের একটি মহাসাগরে।
জ্ঞানভাণ্ডার: পাণ্ডুলিপি ও প্রাচীন কিতাবের স্বর্ণখনি
দেওবন্দের লাইব্রেরি আজ লাখো কিতাব ও পাণ্ডুলিপির আঁধারে পরিণত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে—
১৫,০০০-এরও বেশি হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি, অনেকগুলো একমাত্র কপি হিসেবে সংরক্ষিত।
আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় রচিত মূল্যবান গ্রন্থ।
কুরআনের তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, উসুল, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, তাসাউফ ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক কিতাবের বিপুল ভাণ্ডার।
প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, যা চামড়া, কাপড় ও খাগির পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে।
মনীষীদের মূল রচনা ও শারহসমূহ— ইমাম গাযালী, ইবনে রুশদ, শাহ ওয়ালিউল্লাহ, রুমি, সাদী, ইমাম আবু হানিফা ও ইবনে তাইমিয়ার কালজয়ী কর্ম।
এই সংগ্রহ শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের ইসলামি গবেষকদের নিকট এক আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
বিষয়বৈচিত্র্য: চিন্তার বহুমাত্রিক পরিসর
এই লাইব্রেরির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর বিষয়গত বৈচিত্র্য ও চিন্তার উদারতা।
এখানে রয়েছে চার মাজহাবের মূল ফিকহি কিতাবাবলি।
আহলে হাদীস, সালাফি, মুতাকাল্লিম ও সুফি চিন্তার গ্রন্থাবলি।
যুক্তিবিদ্যা (মান্তিক), অলঙ্কারশাস্ত্র (বালাগাত), দর্শন ও উসুলের মৌলিক রচনাসমূহ।
গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল, গবেষণাপত্র ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ।
ফলে এটি কেবল দেওবন্দি ধারা নয়; বরং একটি বিশ্বমুখী ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত।
প্রভাব ও ভূমিকা: গবেষণা, সংরক্ষণ ও প্রকাশনার কেন্দ্রবিন্দু
দেওবন্দের লাইব্রেরি আজ কেবল একটি সংরক্ষণাগার নয়; বরং তা হয়ে উঠেছে গবেষণা, অনুবাদ, সম্পাদনা ও প্রকাশনার এক পরিপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম।
বহু দুর্লভ পাণ্ডুলিপি ডিজিটালাইজ করে বিশ্বব্যাপী গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
লাইব্রেরির নিজস্ব প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি গ্রন্থ।
এখানকার সহায়তায় বহু ছাত্র ও গবেষক মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা করছেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামী ফিকহ, ইতিহাস ও সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে এই লাইব্রেরির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।
দারুল উলুম দেওবন্দের লাইব্রেরি একটি সময়ের সাক্ষ্য, ইতিহাসের দিগন্ত, এবং ইসলামী জ্ঞানের অতল সমুদ্র। এটি কেবল একটি পাঠাগার নয়— বরং এটি একটি চলমান জ্ঞান-আন্দোলন, এক রেনেসাঁর আলোকবর্তিকা।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে প্রজ্ঞার বাতিঘর জ্বালিয়ে রেখেছে এই প্রতিষ্ঠান, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অফুরন্ত আশীর্বাদ।
এই গ্রন্থাগার প্রমাণ করে— ইসলামি জ্ঞান কেবল মসজিদ বা মিম্বরে সীমাবদ্ধ নয়; বরং গবেষণা, পাঠচর্চা ও চিন্তাশীলতার মাধ্যমে তা হয়ে উঠতে পারে মানবতার মুক্তির পথপ্রদর্শক।
আশা করা যায়, দারুল উলুম দেওবন্দের এই লাইব্রেরি যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহর রূহানী ও জ্ঞাননির্ভর জাগরণে পথ দেখিয়ে যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ
এসএকে/