|| শাব্বির আহমাদ খান ||
দেশের কওমি মাদরাসাগুলো দীর্ঘদিন ধরে ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে আসছে। একটা সময় এই চামড়া কালেকশনের মাধ্যমে মাদরাসাগুলো আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হতো। মোট খরচের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এই খাত থেকে আসতো।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে চামড়া শিল্পকে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোরবানির পশুর চামড়া পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। এমনকি বিক্রি করতে না পেরে তা পানিতে ভাসিয়ে দিতেও দেখা গেছে। এর পেছনে অনেকেই দেশের কওমি মাদরাসাগুলোর পথচলা বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র দেখছেন। যারা কওমি মাদরাসার উত্থান চায় না তারা এর সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করা হয়।
এবার অন্তর্বর্তী সরকার কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। সরকারের এই চেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশের আলেমরা। তারা বলছেন, চামড়া শিল্পের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছে তা রুখতে হলে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এতে একদিকে দেশের চামড়া শিল্প রক্ষা হবে অন্য দিকে হাজার হাজার কওমি মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিং আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
চামড়ার দরপতনের কারণ এবং এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘এক সময় আমরা মাদরাসার জন্য সংগৃহীত চামড়া সাড়ে তিন হাজার থেকে তিন হাজার আটশ টাকায়ও বিক্রি করেছি। বড় চামড়ার মূল্য আরও বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু গত বছর কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র আটশ টাকায়।’
তিনি মনে করেন, এই অবনতির অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিতভাবে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প হেমায়েতপুরে স্থানান্তর এবং পুরোনো কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া। তিনি বলেন, ‘অনেকেই বিশ্বাস করেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতেই দেশের চামড়া শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। আর বিগত সরকার যেহেতু ভারতনির্ভর ছিল, তাই এমন ধারণা খুব একটা অমূলক নয়। এর মাধ্যমে দেশের দীনি মাদরাসাগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করার দূরভিসন্ধি থাকাটাও অসম্ভব কিছু নয়।’
একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন,
‘এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, পতিত সরকার বাংলাদেশের সব সেক্টরকে যেভাবে ধ্বংস করেছে, চামড়া শিল্পকেও সেভাবেই ধ্বংস করে গেছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় একটি সিন্ডিকেট চামড়া শিল্পকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করেছে।’
তিনি অভিযোগ করেন, সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের বহু চেষ্টা করেও সুফল মেলেনি। তবে এবারের ঈদে তিনি আশাবাদী, সরকার যদি চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে মাদরাসাগুলো উপকৃত হবে। এতে প্রকারান্তরে গরিব ও অসহায় মানুষেরাই লাভবান হবে, রক্ষা পাবে দেশের চামড়া শিল্প।
মাদরাসার আয়-ব্যয়ের প্রেক্ষাপটে চামড়া কালেকশন জরুরি বলে মনে করেন বিশিষ্ট এই আলেম। তিনি বলেন, ‘চামড়া খাতের আয় থেকে দেশের কওমি মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোর ব্যয়ের একটি বড় অংশ নির্বাহ করা হয়। এই লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোতে সাধারণত গরিব, দুঃখী ও দুস্থ পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করে, যারা নিজ খরচে পড়ার সামর্থ্য রাখে না। কোরবানির পশুর চামড়া থেকে অর্জিত অর্থ দিয়েই তাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। কাজেই চামড়ার মূল্য কমিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো গরিব মানুষের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। আমরা বিষয়টিকে এভাবেই দেখি।’
জামিয়া হোসাইনিয়া আরজাবাদের মুহতামিম মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘আমরা কোরবানির চামড়া সংগ্রহকে কোনোভাবেই অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখি না। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যেখানে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কোরবানি হয়ে থাকে। এই কোরবানিগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকেরা আত্মনিয়োগ করেন। চামড়া, যা একটি জাতীয় সম্পদ, অনেক সময় কোরবানিদাতারা রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন না। তাই আমরা তা সংগ্রহ করে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করি এবং গরিব-দুঃখীদের হক আদায়ে ভূমিকা রাখি।’
তার মতে চামড়ার দরপতনের জন্য প্রধানত দায়ী সরকারের অবহেলা এবং একটি শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, যারা এই শিল্পকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার চাইলে এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া সম্ভব। আমরা দেখছি, বর্তমান সরকার এ বিষয়ে কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে, তাই আশা করছি এবছর চামড়ার দাম কিছুটা বাড়বে। আমরা সরকারকে সাধুবাদ জানাই এই উদ্যোগের জন্য।
তাকওয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাওলানা গাজী ইয়াকুব আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘চামড়ার মূল্য ক্রমাগত কমে আসছে, যা আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি। এটি কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলেই মনে করি। ষড়যন্ত্রকারীরা কোরবানির পশুর চামড়ার দরপতনের মাধ্যমে মাদরাসাগুলোর আর্থিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিতে চায়। উদ্দেশ্য হচ্ছে—মাদরাসাগুলোকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি পরিবার দিন আনে দিন খায়, এবং তাদের অনেক সন্তানই কওমি মাদরাসাগুলোতে পড়াশোনা করে। এই দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ একটি বড় সহায়তা। সেখানে আর্থিক সংকট তৈরি হলে ছাত্রসংখ্যা কমে যাবে, ফলে শিক্ষাব্যবস্থাটিই হুমকির মুখে পড়বে।’
গাজী ইয়াকুব বলেন, ‘আমরা মনে করি, যদি কখনো পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, চামড়া সংগ্রহ ছাড়া মাদরাসা চালানো সম্ভব, তাহলে সেই পথ বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে একেবারে ঢালাওভাবে এই খাত ছেড়ে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার চামড়া শিল্প নিয়ে ভাবছে, এটি ইতিবাচক একটি দিক। এজন্য আমরা সরকারকে সাধুবাদ জানাই। আশা করি, তারা এই শিল্পখাত রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।’
এসএকে/