নাজমুল হাসান
সময়ের প্রবাহে হারিয়ে গেছে জমিদারি প্রথা, বিলীন হয়েছে জমিদারদের প্রতাপ ও প্রভাব। তবে মুছে যায়নি তাঁদের রেখে যাওয়া ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ছাপ। কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের বুক চিরে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি জমিদার বাড়ি—জাহাপুর জমিদার বাড়ি, বাঙ্গরা রূপবাবু জমিদার বাড়ি, এবং রহিমপুরের পোদ্দার জমিদার বাড়ি। এদের প্রতিটির রয়েছে আলাদা গৌরবময় ইতিহাস, স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক মূল্য।
*জাহাপুর জমিদার বাড়ি*
প্রায় ৪০০ বছর আগে নির্মিত হয় জাহাপুর জমিদার বাড়ি। ইতিহাস অনুযায়ী, এটি নির্মাণ করেন কমলাকান্ত রায় নামের এক জমিদার। বাড়িটির প্রবেশপথে এখনো চোখে পড়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা দুটি সিংহ মূর্তি, যা আগতদের স্বাগত জানায়।
এই বাড়িতে রয়েছে বিশালাকৃতির জগন্নাথ মন্দির, যেখানে এখনও পূজা-পার্বণ পালিত হয়। স্থাপত্যশৈলীতে মুঘল প্রভাব স্পষ্ট—দেয়ালের নকশায় আছে কারুকার্য, আর অভ্যন্তরে রয়েছে জমিদার আমলের আসবাবপত্র, যা ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এক জীবন্ত প্রদর্শনী।
*বাঙ্গরা রূপবাবু জমিদার বাড়ি*
মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা পূর্ব ইউনিয়নের অন্তর্গত ৯টি গ্রামজুড়ে বিস্তৃত ছিল রূপবাবুদের জমিদারি। প্রায় ২৫০ বছর আগে এই জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৮০০ সালে রূপবাবু তাঁর স্ত্রী শান্তমনি দেবীর নামে এক দাতব্য চিকিৎসালয় নির্মাণ করেন, যা সে সময় স্থানীয় মানুষের চিকিৎসা সেবার অন্যতম মাধ্যম ছিল।
আজ সেই দাতব্য ভবনটি অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে, কাঠামোতে ধরেছে জং।
রূপবাবুদের দানকৃত স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে বাঙ্গরা বাজারের জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলো এবং অগ্রণী ব্যাংক শাখা। জমিদার রূপবাবুর বংশধরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—মানিক বাবুর তিন সন্তান: দেবী প্রসাদ মজুমদার, শিবু প্রসাদ মজুমদার, ও শ্যামা প্রসাদ মজুমদার।
বর্তমানে শিবু প্রসাদ মজুমদার পানপট্টির বাঙ্গরা হাউজে অবস্থান করেন এবং মাঝে মাঝে পৈতৃক ভিটায় যান বলেও জানা গেছে।
*রহিমপুরের পোদ্দার জমিদার বাড়ি*
নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন—প্রায় ১১৫ থেকে ১২০ বছর পুরোনো।
বর্তমানে বাড়িটির দেখাশোনা করছেন পিংকো পোদ্দার, যিনি জানান, তাঁর দাদা মনমোহন পোদ্দার ছিলেন এই বংশের জমিদার।
এ বাড়ির ইটের গাঁথুনিতে রয়েছে চমৎকার কারুকাজ, যা আজও দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও এই বাড়ির ইতিহাসে উঠে আসে এক প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগের চিত্র—বাঙ্গরা জমিদার রূপবাবুরাও এখানে যাতায়াত করতেন বলে জানা যায়।
কুমিল্লার জমিদার বাড়িগুলো শুধু স্থাপত্য সৌন্দর্যের নিদর্শন নয়, বরং ইতিহাস-ঐতিহ্যের জীবন্ত সাক্ষী। রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের অভাবে এই নিদর্শনগুলো আজ ধ্বংসের মুখে।
সরকারি উদ্যোগ ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় এসব ঐতিহ্য রক্ষা করা গেলে তা হয়ে উঠতে পারে ইতিহাস শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, এবং সম্ভাব্য পর্যটন আকর্ষণ।
এনএইচ/