বাংলাদেশের স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘দ্বীনিয়াত’ নামে পরিচালিত বিশেষ শিক্ষাধারা পরিচালনা করছেন মুফতি সালমান আহমাদ। তিনি দ্বীনিয়াত বাংলাদেশের প্রধান। বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে চলমান এই বিশেষ শিক্ষা কারিকুলাম বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কয়েক লাখ মানুষ দ্বীনিয়াতের কারিকুলামে দ্বীন শিখছে। দ্বীনিয়াত শিক্ষার ধরন, পদ্ধতি, কারিকুলাম ও কার্যকারিতা নিয়ে মুফতি সালমান আহমাদ দেশ রূপান্তরের মুখোমুখি হন। কথা বলেছেন রকিব মুহাম্মদ-
স্কুলশিক্ষার্থীদের ধর্ম শিক্ষায় বিশ্বব্যাপী সমাদৃত কারিকুলাম দ্বীনিয়াত বাংলাদেশ শাখার প্রধান আপনি। দ্বীনিয়াত বাংলাদেশের কর্মসূচি এবং কবে, কীভাবে এটা শুরু হয়েছে এ সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
সমাজের ৯৮ ভাগ মুসলমান জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত। মাত্র ২ ভাগ মাদ্রাসাপড়ুয়া। ইসলামের মৌলিক জ্ঞান শেখার অধিকার ৯৮ ভাগ মানুষেরও রয়েছে। দ্বীনিয়াত বাংলাদেশ সেই ৯৮ ভাগ মানুষের ধর্মীয় জ্ঞান শেখানোর মৌলিক অধিকার নিয়ে কাজ করছে। তাদের কীভাবে দ্বীনের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় শিক্ষায় আলোকিত করা যায় সেটাই আমাদের মূল পরিকল্পনা। মানুষ তার যাপিত জীবনে ধর্মীয় অনুশীলনের জন্য যে জ্ঞানটুকু দরকার, আমরা তা শিখিয়ে থাকি। এক কথায় বলতে গেলে, দ্বীনিয়াত হলো সাধারণ শিক্ষার্থী ও স্কুলগামী শিশুদের জন্য দ্বীন শেখার স্বতন্ত্র একটি প্ল্যাটফরম।
দ্বীনিয়াত কারিকুলাম মৌলিকভাবে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে কাজ করে?
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত নানা পেশার সঙ্গে সংযুক্ত কর্মজীবী মানুষ, মুসলিম মা-বোনদের নিয়ে আমাদের পথচলা। এই তিন শ্রেণিসহ যারা স্বাক্ষরজ্ঞান থেকে পেছনে রয়েছেন তাদেরও কীভাবে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়, সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দ্বীনিয়াত বাংলাদেশ। যেহেতু আমাদের স্লোগান হলো শতভাগ মানুষকে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করা। এ কারণে দৃষ্টি ও বাকপ্রতিবন্ধীদের নিয়েও রয়েছে আমাদের বিশেষ পদ্ধতির পড়াশোনা। এ ছাড়া সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সেবা ও শিক্ষা প্রদানেও দ্বীনিয়াত বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। দ্বীনিয়াত প্রকাশিত বিশেষ সিলেবাসের মাধ্যমে তারা ধর্মীয় জ্ঞান শিখছে। অন্ধদের জন্যও দ্বীনিয়াত সম্পূর্ণ সিলেবাস প্রকাশ করেছে।
দ্বীনিয়াত বাংলাদেশ কোন পদ্ধতিতে পাঠদান করে? সেখানে কারা ওস্তাদ এবং কীভাবে পাঠদান করেন?
আপনি জানেন, বাংলাদেশের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা হলো মক্তব শিক্ষাব্যবস্থা। আমরা মূলত সেই মক্তব ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাই। প্রসঙ্গক্রমে বলি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও এ কথা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মক্তব শিক্ষাটাই প্রাচীনতম শিক্ষাব্যবস্থা।’ আসলে শুধু বাংলাদেশ নয়, যত মুসলিম দেশ রয়েছে; সবখানে মক্তব শিক্ষাকে প্রাথমিক শিক্ষা মনে করা হয়। বর্তমানে আমাদের মক্তব শিক্ষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। আমরা সেই পদ্ধতি ফিরিয়ে এনেছি আধুনিক ও মানসম্মত কারিকুলামে। দ্বীনিয়াতের শিক্ষা কারিকুলাম ৩ স্তর বিশিষ্ট। ১. প্রাইমারি, ২. সেকেন্ডারি, ৩. অ্যাডভান্স।
এই তিনস্তরের শিক্ষা কারিকুলাম দুভাবে পরিচালিত হয়। এক. স্কুলের সাধারণ পাঠ্যসূচির সঙ্গে। দুই. সকালবেলার মক্তবে। উভয়ক্ষেত্রে দ্বীনিয়াত প্রতিদিন সময় নেয় ১ ঘণ্টা করে। স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য দ্বীনিয়াত সেন্টার নামে একটা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সেখানে এসে যার যার সুবিধামতো সময় অনুযায়ী একজন শিক্ষকের কাছে দ্বীন শিখে যায়।
১ ঘণ্টায় কতটুকু ধর্মীয় জ্ঞান শেখা সম্ভব? এ সময়ে তাদের কী পড়াতে চান, কী পড়াচ্ছেন?
প্রতিদিন ১ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে একজন স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী দ্বীনের পাঁচটি মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। কোরআন, হাদিস, আকাইদ, মাসায়েল ও ইসলামি তরবিয়ত এবং আরবি ভাষা। সহিহ শুদ্ধভাবে কোরআন দেখে তেলাওয়াত করা, হাদিস মুখস্থ করা, কোরআনের মৌলিক সুরা, প্রয়োজনীয় মাসয়ালা, মাসনুন দোয়া ইত্যাদি বিষয় তারা দ্বীনিয়াত কারিকুলামে শিখতে ও পড়তে পারবে।
দ্বীনিয়াতের সিলেবাস পড়ে কেউ কি কোরআনের হাফেজ হতে পারবে?
দ্বীনিয়াত বাংলাদেশে যেহেতু শতভাগ মানুষকে দীন শিক্ষা দেয়। দ্বীনিয়াত বাংলাদেশ হিফজের ব্যবস্থাও করে রেখেছে, আফটার স্কুল তাহফিজ নামে। স্কুল শেষ করার পর একজন শিক্ষার্থী দ্বীনিয়াতের সেন্টার কিংবা কোনো শাখায় যদি প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে, তবে তারা কোরআন মাজিদ হেফজ করতে পারবে। ক্লাস ফাইভে পড়া পর্যন্ত তার হেফজ পড়া শেষ হয়ে যাবে। সে একজন দক্ষ হাফেজ হিসেবে গড়ে উঠবে। সেই সঙ্গে বাচ্চারা দ্বীনের প্রাথমিক জ্ঞানও অর্জন করতে পারবে।
দ্বীনিয়াতের সঙ্গে আপনি কীভাবে সম্পৃক্ত হলেন? বাংলাদেশে দ্বীনিয়াতের কার্যক্রম শুরুর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাই।
দ্বীনিয়াতের প্রথম ধারণা তৈরি হয় ১৯২৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়। তখন দক্ষিণ আফ্রিকার আলেমরা ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের দ্বীন শেখার ব্যবস্থা করে। দক্ষিণ আফ্রিকার কারিকুলামটির নাম তাসহিল (সহজ দ্বীনশিক্ষা)। ভারতের একদল মুসলিম দক্ষিণ আফ্রিকায় সফর করেন। সফর করার পর তারা দেখতে পান সেখানে মুসলিম শিশুদের জন্য ইসলামি শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। তখন তারা সাধারণ শিক্ষা লাভের পাশাপাশি মুসলিম শিশুরা যেন ইসলামি শিক্ষা লাভ করতে পারে সে জন্য এ কারিকুলাম চালু করেন।
ভারতের মুম্বাইয়ে জিম্মাদার হাজী রফিক এশিয়া মহাদেশের উপযোগী করে এই বিষয়টির জন্য নিজের জানমাল কোরবান করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় আলেম উলামা দারুল উলুম দেওবন্দের পরামর্শে এ সিলেবাস প্রণয়ন করেন। বর্তমানে বিশ্বের ৪০টি দেশে দ্বীনিয়াতের কার্যক্রম রয়েছে। দ্বীনিয়াতের সিলেবাসভুক্ত বইগুলো প্রায় ৩০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
২০০৫ সালের দিকে আমি আফ্রিকা সফর করি। সেখানে প্রত্যেকটি বাচ্চা স্কুল-কলেজে পড়ে কিন্তু এর আগে তারা হাফেজে কোরআন হয়। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, একেকজন একেকটা হচ্ছে। এর আগে তারা হাফেজে কোরআন হয়েছে। কীভাবে হলো? যখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলাম, দেখলাম প্রত্যেক বাচ্চা স্কুলে যাওয়ার আগে বা পরে এই দুই সময়ের যে কোনো এক সময় তারা দ্বীনিয়াতের সিলেবাস অনুসরণ করে দ্বীন শিক্ষা করে। এরপর আমি দ্বীনিয়াতের কাজ দেখতে শ্রীলঙ্কা সফর করি। এ ছাড়া ব্রাজিল, চিলি ও পানামাসহ বিভিন্ন দেশে দ্বীনিয়াতের কার্যক্রম দেখেছি। বেশ কয়টি দেশ সফর করে এই সিলেবাসের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ তৈরি হয়। আমি ভারতের মুম্বাইয়ে যোগাযোগ করে বেশ কয়েকটি বই অনুবাদ করি। ১ম ও ২য় বর্ষের বইয়ের পড়ানোর বিস্তারিত বিষয়ে জানি। পরে বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করি ২০০৯ সালে। আমার সঙ্গে মুফতি নোমান আহমদ কাসেমি এই কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন শুরু থেকে। দ্বীনিয়াতের সিলেবাস অনুবাদের ক্ষেত্রে তার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানেও তিনি দ্বীনিয়াতের কাজে সক্রিয়।
দ্বীনিয়াত বাংলাদেশ নিয়ে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা কী?
আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি মসজিদকে একটি জীবন্ত মসজিদ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, এ লক্ষ্যে কাজ চলমান। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সারা দেশে মসজিদভিত্তিক মক্তব গড়ে তুলতে চাই। কারণ, মক্তব ছাড়া মসজিদ জীবন্ত হয় না। মানুষের সুবিধামতো সময়ে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে চাই। এটি আমাদের দ্বিতীয় পদক্ষেপ। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মক্তব কায়েম করা। পথশিশু ও নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমাদের কার্যক্রম চলছে। সময়ে সময়ে স্কুল-কলেজপড়ুয়া নারীদের জন্য দ্বীন শেখানোর পাশাপাশি বিশেষ প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করা হয়। আমাদের আরও বেশকিছু পরিকল্পনা রয়েছে, সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করছি ইনশাআল্লাহ।
‘পাঁচ মিনিটের মাদ্রাসা’ নামে দ্বীনিয়াত কর্র্তৃক প্রকাশিত একটি বই রয়েছে। এটি জনসাধারণের জন্য কতটুকু উপকারী?
শিক্ষার্থীদের জন্য দ্বীনিয়াতের নিয়মিত ক্লাসের পাশাপাশি বিভিন্ন বই-পুস্তক থাকলেও সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য উপকারী একটি গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরেই অনুভব হচ্ছিল। সেই শূন্যতা পূরণে দ্বীনিয়াতের ‘পাঁচ মিনিটের মাদ্রাসা’ বইটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। আরবি মাসের তারিখ অনুযায়ী সন্নিবেশিত বইটির ভূমিকাতে লেখা হয়, মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর কিতাব এবং হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শের কাছাকাছি করার উদ্দেশ্যে এই কিতাব কোরআন-হাদিসের আলোকে সংকলন করা হয়েছে। এতে দ্বীনের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কোরআন-হাদিসের আলোকে ১০টি শিরোনামে একত্রিত করা হয়েছে। একদিনের পাঠে ১০টি করে বিষয় রয়েছে। দিনে ৫ মিনিট পড়ে পুরো বছরে ৩ হাজার ৫ শ বিষয়ে জানা যাবে।
দ্বীনিয়াতের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান?
আমি শিক্ষকদের উদ্দেশে বলব, সাধারণ মানুষের দ্বীনি শেখার মৌলিক অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আপনারা দেশের সাধারণ মানুষের নিরক্ষরতা দূর করতে কাজ করবেন। এ দেশের একজন শিশুও যেন দ্বীনি শেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে সচেষ্ট থাকবেন।
অভিভাবকদের বলব, দুনিয়া ও আখেরাতে সুখে-শান্তিতে থাকতে সন্তানকে অবশ্যই দ্বীনিদার বানাবেন। যদি আদর্শ সন্তান দুনিয়াতে তৈরি করতে পারি, তাহলে এই সন্তান আমাকে যেমন মূল্যায়ন করবে; আমার সৃষ্টিকর্তাও তেমন মূল্যায়ন করবে। মনে রাখবেন, দ্বীনি শেখার বিকল্প কোনো কিছু নেই।
সূত্র: দৈনিক দেশ রূপান্তর
কেএল/