|| রমযান রব্বানী ||
মসজিদের আঙিনার সামনের দিকটায় ইট-দেয়ালে ঘেরা একটি ছোট্ট বাউন্ডারি। ভেতরে শান্ত, নীরব ঘুমিয়ে আছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেম, অগণিত ছাত্রের ওস্তাদ-আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ.। চারপাশ নিস্তব্ধ, যেন বাতাসও মৃদু ভক্তির আবেশে স্তব্ধ হয়ে আছে। তিনি ছিলেন দীর্ঘ সময়ের জন্য ঢাকার চৌধুরীপাড়ায় অবস্থিত শেখ জনুরুদ্দীন দারুল কুরআন মাদরাসার মুহতামিম। তাঁর নেতৃত্বে এ মাদরাসা শিক্ষা ও খেদমতে খ্যাতি অর্জন করে। অসংখ্য ছাত্র তাঁর হাতে ইলমের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করেছে। সরল জীবনযাপন, দৃঢ় সুন্নাহনিষ্ঠতা এবং নিরলস পরিশ্রম তাঁকে ছাত্র-শিক্ষক মহলে এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল।
তাঁরই অন্যতম গুণী ছাত্র হলেন বর্তমান সময়ের খ্যাতিমান আলেম শায়খ মুফতী হাফীজুদ্দীন সাহেব দা.বা.। যিনি বর্তমানে রাজধানীর প্রখ্যাত দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের নায়েবে মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শায়খের ইলমি প্রতিভা, নেতৃত্বগুণ ও দাওয়াতি খেদমত নিঃসন্দেহে তাঁর ওস্তাদ ইসহাক ফরিদী রহ.-এরই ছায়াস্বরূপ উত্তরাধিকার।
শায়খ মুফতী হাফীজুদ্দীন সাহেব (দা.বা.) ধীরপদে এসে দাঁড়ালেন তাঁর ওস্তাদের কবরের ঠিক পাশে। দীর্ঘশ্বাসের মতো ভারী নীরবতা নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সমাধিফলকের দিকে। যেন স্মৃতির পর্দা খুলে যাচ্ছে, আর তার ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে উঠছে যৌবনের দিনগুলো- যখন তিনি ওস্তাদের পায়ের ধুলায় বসে হাদিস শুনতেন, ইলমের আলোয় হৃদয় ভিজিয়ে নিতেন।
শায়খ আস্তে আস্তে কবরের মাটির পাশে দাঁড়ালেন। তাঁর ঠোঁটে গুণগুণ করে ভেসে উঠল দরুদ, ইস্তেগফার আর দোয়ার শব্দ। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি দোয়া যেন কবরের মাটিতে মিশে গিয়ে ওস্তাদের রুহের কাছে ছাত্রের অনুগত কৃতজ্ঞতা পৌঁছে দিচ্ছে। 
হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন, কবরের চারপাশে ছোট ছোট আগাছা গজিয়ে উঠেছে। শায়খের হাত এগিয়ে গেল। তিনি নিজ হাতে আগাছাগুলো টেনে তুলতে লাগলেন, মাটি ঝেড়ে পরিষ্কার করলেন। এ দৃশ্য দেখে পাশে দাঁড়ানো এক ছাত্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। শায়খ তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘মাঝে মাঝে এসে হুজুরের কবরটা পরিষ্কার করে দিও।’ 
এরপর তিনি কবরের নামফলকের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘দেখছো? নেমপ্লেটে শ্যাওলা জমেছে। টিস্যু দিয়ে সুন্দর করে মুছে দাও তো!’ কবরের মাটি তখন সিক্ত হলো শায়খের দোয়ায়। ছাত্রের হাতে তোলা আগাছার মুঠো যেন সাক্ষ্য দিল-একজন শাগরেদ তাঁর ওস্তাদের প্রতি কতটা অনুগত, কতটা কৃতজ্ঞ হতে পারে। সেই নিস্তব্ধ কবরস্থানে দাঁড়িয়ে মনে হলো-জীবন হয়তো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ওস্তাদ ও শাগরেদের সম্পর্ক অমর। ইলমের নূর আর স্নেহের বন্ধন মাটির নিচে গিয়েও মুছে যায় না।
এসএকে/
                              
                          
                              
                          
                        
                              
                          