|| মাওলানা মামুনুল হক ||
২০২১ সালে হেফাজতে ইসলামের ওপর ফ্যাসিবাদী আওয়ামী বর্বর শক্তির ক্র্যাকডাউনের অন্যতম টার্গেট ছিলাম আমি। স্বৈরাচারী খলনায়িকা শেখ হাসিনা ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা সম্মিলিতভাবে হামলে পড়েছিল আমার ওপর। হাসিনা রেজিমের অন্যতম ভয়াবহ একটা দিক ছিল যে, দৃশ্যমান হাসিনা একটা হলেও প্রশাসনের সব সেক্টরে একটা একটা করে অদৃশ্য হাসিনা উপবিষ্ট ছিল। বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ছিল এই হাসিনাদের রাম রাজত্ব। একটা নয় বরং একাধিক হাসিনা বিরাজমান ছিল এক একটা গোয়েন্দা সংস্থার মাথায়। এই সকল হাসিনারা মিলে একযোগে হায়েনার মতো হামলে পড়েছিল আমাদের ওপর। আমার ওপর। তাদের সেই হামলা ও ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত দাস্তান তুলে ধরা আজকের আলাপ না।
আজ বলতে চাই অন্য আরেকটি গল্প-
গতকাল ১১ সেপ্টেম্বর ছিল পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়া ঐতিহাসিক নাইন ইলেভেনের আলোচিত দিবস। এদিনেই হাটহাজারীর ডাকবাংলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় মরহুম আমিরে হেফাজত কায়েদে মিল্লাত আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবন ও কর্ম শীর্ষক এক আলোচনা সভা। উক্ত সভায় যোগদানের সৌভাগ্য আমার হয়। আর সেই উপলক্ষেই গতকাল আমিরে হেফাজত আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর সাহচর্য লাভে ধন্য হই আমি। অল্প সময়ের এই সাক্ষাৎপর্ব হয়ে ওঠে আমার জন্য আরেক সৌভাগ্যের উপলক্ষ। সেটি বলার আগে আবারো একটু ঘুরে আসি ২০২১ থেকে। ইতিহাসের বর্বরতম নারকীয় ও ঘৃণ্য আওয়ামী বর্বরতার যুগ থেকে।
ষড়যন্ত্রের খলনায়িকা শেখ হাসিনার ষড়যন্ত্রের মুখে কীভাবে সরলপ্রাণ আল্লাহওয়ালা এক বুজুর্গ ইস্তেকামাতের পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বলি সেই কিংবদন্তি গল্পের কথা।
কায়েদে মিল্লাত আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর হাতকে দুর্বল করতে ও হেফাজতের মাঠ পর্যায়ের উদ্দীপ্ত তারুণ্যকে অবদমিত করতে তারা আমাকে ঘায়েল করার পরিকল্পনা আঁটে। সেই হিসেবেই দাবার গুটির মতো একটা একটা কূটচাল চালে ষড়যন্ত্রের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হাসিনারেজিম। ২০২১ সালের ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে আমাকে নিয়ে ঘৃণ্য এক ষড়যন্ত্রের খেলা শুরু হয় তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের প্রত্যক্ষ প্রযোজনায় পুলিশ ও স্থানীয় বাকশালী ঘাদানিক চক্র আর মিডিয়া পাড়ার আওয়ামী কুকুরদের হামলে পড়ার মধ্য দিয়ে। এরপর থেকে একযোগে সরকারের সবগুলো সংস্থা একে একে মঞ্চস্থ করে নাটকের পরবর্তী দৃশ্যগুলো।
কিছু কুলাঙ্গার দরবারি মোল্লা হাজির হয় নাটকের দৃশ্য মঞ্চায়নে। তারা আওয়ামী বয়ানগুলো নির্দ্বিধায় গেয়ে চলে মিডিয়ার ক্যানভাসে।
অপরদিকে গোয়েন্দা সংস্থার আনাগোনা বেড়ে যায় আমাদের অঙ্গনে। মাঠের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য হেফাজতকেই আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার অপচেষ্টা চালায় তারা। হেফাজতকে আমার বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ক্রমাগত চাপ ও হুমকি প্রদান করে।
এহেন প্রেক্ষিতে হাটহাজারী মাদরাসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনার লক্ষ্যে মিটিং আহ্বান করা হয়। সেই মিটিংয়ে যেন আমি অথবা আমার ঘনিষ্ঠ কেউ উপস্থিত হতে না পারি, সে জন্য কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। আমার বড় ভাই হেফাজতের প্রভাবশালী দায়িত্বশীল মাওলানা মাহফুজুল হক সাহেবকে সে বৈঠক থেকে ফেরাতে শীর্ষ এক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান স্বয়ং নিজে মাঠে নামে।
ওদিকে ডিজিএফআই এনএসআই হেফাজতের দায়িত্বশীলদেরকে বিভ্রান্ত করার কৌশল গ্রহণ করে। হেফাজতের অনেক দায়িত্বশীলকে এই মর্মে আশ্বাস দেয়, যদি মামুনুল হকের বিরুদ্ধে হেফাজত সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সরকারি খড়গের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে হেফাজত আর অন্যান্য দায়িত্বশীলগণ। আর তাই হাটহাজারীতে অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলামের সেই বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্ররোচনায় প্রভাবিত দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা চলে। এভাবেই হেফাজতকে পরস্পরবিরোধী ভ্রাতৃঘাতী এক লড়াইয়ে জড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে তারা।
আল্লাহর মেহেরবানি, তাদের ষড়যন্ত্রের সর্বপ্লাবী ঢেউগুলো যেন আছড়ে পড়েছিল ইস্তেকামাতের পাহাড়সম এক ব্যক্তির পায়ের তলে। যিনি আস্থা ও বিশ্বাসের দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যান ষড়যন্ত্রের ঝড়ের মুখে। তিনি হলেন বর্তমান আমিরে হেফাজত ওলী ইবনুল ওলী আল্লামা শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী হাফিজাহুল্লাহ। আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আনীত প্রস্তাবকে ডাইনি হাসিনার ষড়যন্ত্র বলে সরাসরি প্রত্যাখান করেন তিনি এবং নতজানু নেতাদেরকে আচ্ছামতো শাসিয়ে দেন। বিভিন্নভাবে সাজিয়ে আনা গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের ষড়যন্ত্রের পাহাড় যেন তাঁর মুখের এক ফুৎকারেই উবে যায়।
আমার প্রতি আল্লাহর অশেষ করুণা ও মেহেরবানি যে, তিনি মুস্তাযাবুদদাওয়াহ হকের প্রশ্নে আপোষহীন অবিচল এমন মানুষের হৃদয়ে আমার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও অনুরাগ ঢেলে দিয়েছেন। যার ভালোবাসা, কল্যাণকামনা আর দোয়া হিংস্র হয়নাদের ভয়ংকর হামলার মুখে রহমতে এলাহীর আশ্রয় হয়ে সাহায্য করেছে আমায়।
আমার মুক্তির পর ফ্যাসিবাদী আমলেই প্রশাসনের বাধার মুখেও আমাকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের মুখে আরেকটি চপেটাঘাত করেন তিনি।
মহান আল্লাহর কুদরত! যার রহস্য উন্মোচন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
গতকালকের আলোচনা সভার এক ফাঁকে হজরত বাবুনগরীর সাহচর্যে আবারো প্রীত হলাম। নতুন করে অনুভব করলাম মাথার উপর বটবৃক্ষের শীতল ছায়া।
বিদায় বেলা যখন তার কাছে দোয়া চাইলাম, তিনি আমাকে অভিভূত ও মুগ্ধ করে দিয়ে একটি কথা বললেন। খুবই ছোট্ট কথা, তবে তা হৃদয়গ্রাহী, চক্ষু শীতলকারী আর অন্তরে প্রশান্তি দায়ক! তিনি বললেন, ‘অন্তরের ভেতরে রয়েছে তোমার স্থান!’
সুবহানাল্লাহ! কোন ভাষায় শোকর গুজারি আদায় করব আল্লাহ তোমার ! যুগের এক নকীব মুস্তাযাবুদদাওয়াহ এমন ব্যক্তির হৃদয়ের মণিকোঠায় তুমি স্থান দিয়েছো আমায়। সবই তোমার মেহেরবানি!
রব্বে কাবা, তুমি যেভাবে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত করলে আমায়,
স্মরিত করলে অজস্র মানুষের কান্নাভেজা দোয়ায়,
এভাবেই পার করে দিও আমার দোজাহানের তরী।
লেখক: যুগ্ম মহাসচিব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
এসএকে/