সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫ ।। ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ ।। ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

শিরোনাম :
দুর্যোগ কবলিত শ্রীলঙ্কায় ত্রাণসামগ্রী ও উদ্ধারকারী দল পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ জোটবদ্ধ নির্বাচনে নিজ নিজ প্রতীকের বিধান কেন অবৈধ নয়, হাইকোর্টের রুল অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করেছে: মোহাম্মদ কামাল হোসেন বিশ্ব এইডস দিবস ২০২৫: অজ্ঞতা ভাঙলেই কমবে সংক্রমণের ঝুঁকি ‘আগামী নির্বাচনে ইসলামি শক্তির বিজয় নিশ্চিত করতে হবে’ তিন মাসে বয়ে যেতে পারে ৮টি শৈত্যপ্রবাহ জোড় ইজতেমার আখেরি মোনাজাত কাল সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আইয়ুব মিয়া জমিয়ত ঘোষিত প্রার্থীদের গণসংযোগ অব্যাহত রাখার নির্দেশনা আফগান যুদ্ধাপরাধ ধামাচাপা দিয়েছিল যুক্তরাজ্যের বিশেষ বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা

বিশ্ব এইডস দিবস ২০২৫: অজ্ঞতা ভাঙলেই কমবে সংক্রমণের ঝুঁকি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

||ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ||
 
আজ সোমবার, ১ ডিসেম্বর—বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে সচেতনতা সভা, মানববন্ধন, র‍্যালি, স্কুল–কলেজে স্বাস্থ্যশিক্ষা আয়োজন, গণমাধ্যম প্রচার, আলোচনা ও পোস্টার ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব এইডস দিবস ২০২৫। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বরকে বিশ্ব এইডস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়—বিশ্ববাসীকে এইচআইভি/এইডস সম্পর্কে জানানো, ভুল ধারণা সংশোধন করা এবং এইডসে মৃত্যুবরণকারী মানুষদের স্মরণ করার উদ্দেশ্যে। এইডসকে কেবল একটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের সমস্যা হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এটি একই সঙ্গে একটি সামাজিক, মানসিক ও আচরণগত সংকট। দারিদ্র্য, বৈষম্য, কুসংস্কার, সচেতনতার অভাব, সঠিক যৌনশিক্ষার অভাব এবং সামাজিক লজ্জা—সব মিলেই এই রোগের বিস্তারকে জটিল করে তুলেছে। এখনো অনেক মানুষ এইডসের নাম শুনলেই ভীত হয়ে পড়েন, আক্রান্ত ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলেন, এমনকি ভুল তথ্যের কারণে অকারণে আতঙ্কিত হন। অথচ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারই সংক্রমণের সবচেয়ে বড় অনুঘটক। তাই ২০২৫ সালের বিশ্ব এইডস দিবসের মূল লক্ষ্য—সচেতনতার আলো ছড়িয়ে অজ্ঞতার দেয়াল ভেঙে ফেলা।
 
এইচআইভি ভাইরাসের উৎপত্তি : বিজ্ঞান যা বলছে
গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, আফ্রিকার কঙ্গো অঞ্চলে ১৯২০ সালের দিকে এই ভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা যায়—কিনসাসা শহর ছিল তৎকালীন সময়ে বাণিজ্য, চাকরি এবং অভিবাসনের কেন্দ্র, যে কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জমায়েত হতো। বন থেকে বন্যপ্রাণীর মাংস সংগ্রহ, শ্রমিকদের আবাস পরিবর্তন, নদীপথ ও রেলপথে মানুষের অবাধ যাতায়াত এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক অজ্ঞতা মিলেই ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শিম্পাঞ্জি, বানর, গোরিলা থেকে একাধিক ধরনের ভাইরাস মানুষের শরীরে আসে; তবে এইচআইভি–১ এর ‘এম গ্রুপ’ সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে এবং এটিই আজ বিশ্বব্যাপী এইডস বিস্তারের মূল কারণ। ১৯৬০ সালের পর যৌনকর্ম কেন্দ্রিক শহুরে পরিবর্তন, দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহার, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং অনিরাপদ যৌন আচরণের ফলে ভাইরাসটির বিস্তার আরও ত্বরান্বিত হয়। এসব তথ্য প্রমাণ করে —এইডস কোনো রহস্যময় অভিশাপ নয়, বরং বিজ্ঞানভিত্তিক একটি সংক্রামক রোগ যার বিস্তারে সামাজিক কাঠামো ও আচরণগত ঝুঁকি বড় ভূমিকা রাখে।
 
বিশ্বে ও বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি
বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি ৪১ লাখ মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ ৪০ হাজার মানুষের। উন্নত চিকিৎসা, সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে মৃত্যুহার আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক ১৪ হাজার মানুষ এইচআইভি আক্রান্ত। শনাক্ত হওয়া ৮,৭৩২ জনের মধ্যে প্রায় ৭৬ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় রয়েছে। ২০২৪ সালে নতুন শনাক্ত হওয়া ৭২৯ জনের মধ্যে পুরুষ ৪২০, নারী ২১০, তৃতীয় লিঙ্গ ১২, রোহিঙ্গা ১৮৮, বিদেশফেরত প্রবাসী ও তাদের পরিবার ১৪৪, ইনজেকশন ড্রাগ ব্যবহারকারী ৬১, সমকামী ৬৭, নারী যৌনকর্মী ১৭ এবং পুরুষ যৌনকর্মীর সংখ্যা ৫৩ জন। একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো—বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হন এবং তিনি এখনো চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, যা প্রমাণ করে—এইচআইভি সময়মতো শনাক্ত ও চিকিৎসা নিলে জীবন অনেকদিন সুস্থভাবে চলতে পারে।
 
কেন পালন করা হয় বিশ্ব এইডস দিবস?
এইডসের বিস্তার রোধে চারটি বড় সামাজিক বাধা—অজ্ঞতা, কুসংস্কার, লজ্জা এবং বৈষম্য। অনেকে এখনো ভুলভাবে মনে করেন, কেবল যৌন সম্পর্কেই এইডস হয়। কিন্তু বাস্তবে দূষিত রক্ত, ব্যবহৃত সুচ–সিরিঞ্জ, আক্রান্ত মায়ের দুধ, বীর্য বা যোনি নিঃসরণ, দূষিত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এবং খোলা ক্ষতের সংস্পর্শে (বিশেষ পরিস্থিতিতে) ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। তাই বিশ্ব এইডস দিবসের লক্ষ্য—ভুল ধারণা ভাঙা, সংক্রমণ প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করা, আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি সহমর্মিতা বাড়ানো এবং বৈষম্য কমানো।
 
কীভাবে ছড়ায় এইডস?
অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক, কনডম ছিঁড়ে যাওয়া, একই সুচ বা সিরিঞ্জ একাধিকবার ব্যবহার, আক্রান্ত মায়ের দুধের মাধ্যমে সংক্রমণ, অনিরাপদ রক্ত গ্রহণ, দূষিত চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং খোলা ক্ষতের সংস্পর্শ—এসবই এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান পথ।
 
এইডসের লক্ষণ—যেগুলো দেখা দিলে সতর্ক হবেন
প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, ফুসকুড়ি, অবসাদ ও গ্রন্থি ফুলে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। উন্নত পর্যায়ে ওজন কমে যাওয়া, দীর্ঘমেয়াদি কাশি, রাতের ঘাম, অন্ত্রের সমস্যা, মুখে সাদা দাগ, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়া, ঘাড় ও কুঁচকিতে গ্রন্থি ফোলা এবং ত্বকে অস্বাভাবিক দাগ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় আবার কোনো উপসর্গই থাকে না; তাই ঝুঁকি থাকলে নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।
 
প্রতিরোধই সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র
বিবাহবহির্ভূত ও ঝুঁকিপূর্ণ যৌনসম্পর্ক এড়িয়ে চলা, নিয়মিত ও সঠিকভাবে কনডম ব্যবহার, ইনজেকশন ড্রাগ পরিহার, প্রয়োজনীয় হলে নতুন সুচ–সিরিঞ্জ ব্যবহার, নিরাপদ রক্ত গ্রহণ, যৌনবাহিত রোগে দ্রুত চিকিৎসা, এইচআইভি আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ, সঠিক যৌনশিক্ষা এবং সামাজিক কুসংস্কার দূর করা—এসবই সংক্রমণ প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখে।
 
এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি মানবিক আচরণ
এইডস মানেই মৃত্যু নয়। এ রোগ এখন দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনায় রাখা যায়। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করা, মানসিক সমর্থন দেওয়া, কর্মসংস্থান বা সামাজিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করা, পরিবারকে সহায়ক ভূমিকা রাখা এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করা—এসব অত্যন্ত জরুরি। বৈষম্যই আক্রান্ত মানুষকে চিকিৎসা থেকে দূরে ঠেলে দেয়, ফলে সংক্রমণও বেড়ে যায়।
 
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
১০ দিনের বেশি জ্বর, দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া, মুখে বা যৌনাঙ্গে ঘা, ছত্রাক সংক্রমণ, অকারণে ওজন কমা, অতিরিক্ত ক্লান্তি, ঘাড়–কুঁচকির গ্রন্থি ফোলা বা ত্বকে রক্তক্ষরণের দাগ দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। আগে শনাক্ত হলে চিকিৎসা অনেক বেশি কার্যকর।
 
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা : গবেষণা যা বলছে
এইচআইভি/এইডস জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ। আধুনিক চিকিৎসা এর মূলে থাকলেও বিভিন্ন দেশে হোমিওপ্যাথি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে ১৯৮৯ সাল থেকে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়—কমপক্ষে ২২ ধরনের হোমিওপ্যাথিক ওষুধ উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখে, রোগীর শারীরিক–মানসিক অবস্থা উন্নত করে এবং সংক্রমণজনিত জটিলতা কমাতে সাহায্য করে। “HIV/AIDS and Homeopathic Management” গ্রন্থে এসব গবেষণার বিস্তারিত পাওয়া যায়। করোনা, ডেঙ্গু, সোয়াইন ফ্লুর মতো সংক্রমণকালীন সময়ে হোমিও চিকিৎসায় রোগীরা উপকার পেয়েছেন—এসবেরও বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন জরুরি।
 
পরিশেষে
এইডস সম্পর্কে ভয়, কুসংস্কার, লজ্জা ও বৈষম্য—সবই সংক্রমণের মতোই বিপজ্জনক। প্রতিটি জেলায় সহজলভ্য এইচআইভি পরীক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ চিকিৎসা, বৈষম্যহীন সামাজিক পরিবেশ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং যৌনশিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে এইডস সংক্রমণ আরও কমে আসবে। অজ্ঞতা ভাঙাই সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রথম ধাপ। সচেতন থাকাই সর্বোচ্চ সুরক্ষা।
 
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
ইমেইল: drmazed96@gmail.com
 
এলএইস/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ