মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫ ।। ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ২২ জিলকদ ১৪৪৬


তারাবি ও তাহাজ্জুদ: পার্থক্য মূলত কোথায়?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ড. মুফতি হুমায়ুন কবির: বর্তমানে কিছু মানুষ তারাবী ও তাহাজ্জুদের মাঝে পার্থক্য না করে তারাবীকে আট রাকাত দাবী করে থাকে। আহলে হাদিছের ইমাম উবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী ও হানাফীদের আল্লামা কাশ্মীরি রমযানে তাহাজ্জুদ ও তারাবীকে এক মনে করেন। যা মূলত তাদের বুঝার ত্রুটি। তারাবী ও তাহাজ্জুদ এক নয়।

নিন্মেএর প্রমাণ তুলে ধরা হলো: ১. তাহাজ্জুদ প্রথমে ফরয ছিল পরে তা রহিত হয়ে গেছে। আর তারাবী তো কখনো ফরয ছিল না। বরং তা শুরুতেই সুন্নাত। বায়হাকী বর্ণনা করেন, “সালামা বিন আবদুর রহমান বলেন, তার পিতা রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে রমযানে শ্রবণ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ রমযানের রোজা ফরয করেছেন ও আমি এর রাত্রি জাগরণ সুন্নাত করেছি। তাই যে রোজা রাখবে ঈমান ও পুণ্যের আশায় সে পাপ থেকে জন্মের সময়ের মত পরিষ্কার হবে।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিছ নং: ১৬৬০)। এর সনদ দূর্বল।

২. তাহাজ্জুদ তো কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, “রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করুন অতিরিক্তিভাবে; যাতে আপনার রব আপনাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছিয়ে দেন।” (ইসরা, আয়াত: ৭৯)।

আর তারাবী সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। বায়হাকী বর্ণনা করেন, “আবদুর রহমান বিন আউফ নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় আল্লাহ রমযানের রোজা ফরয করেছেন। আর আমি রমযানের তারাবী সুন্নাত করেছি। তাই যে ঈমান, পুণ্য ও বিশ্বাস নিয়ে রোজা রাখবে তার জন্য পূর্বের পাপের কাফ্ফারা হবে।” (শুআবুল ঈমান, হাদিছ নং: ৩৩৪২)।

৩. তারাবী রাতের শুরুতে পড়া উত্তম। আর তাহাজ্জুদ শেষে পড়া উত্তম। ইমাম তিরমিযী ও আবু দাউদ বর্ণনা করেন, “হযরত আবু যর থেকে বর্ণিত: আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে রোজা রাখলাম।

তিনি আমাদের সাথে নামাজ পড়লেন না। বাকী রইল মাসের সাত দিন। তখন তিনি আমাদের নিয়ে তারাবী পড়ালেন রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। অতঃপর তিনি পরদিন নামাজ পড়াননি। এর পরের দিন আবার তারাবী পড়ালেন অর্ধ রাত পর্যন্ত। তখন আমরা তাকে বললাম হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনি আমাদের নিয়ে বাকী রাত নফল পড়াতেন।

তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ইমামের সাথে দাঁড়াল শেষ পর্যন্ত তাকে সারা রাত নামাজের পুণ্য দেওয়া হবে। অতঃপর তিনি আমাদের পড়ালেন না। মাসের তিনদিন বাকী রইল। তিনি আমাদের তৃতীয়বার নামাজ পড়ালেন তাতে তিনি তাঁর পরিবার ও বিবিদেরকেও শরীক করলেন। এত দীর্ঘ করলেন আমরা সেহেরী হারিয়ে ফেলার উপক্রম হলাম। হাদিছটি হাসান ও সহিহ।” (তিরমিযী, হাদিছ নং: ৮০৬; আবু দাউদ, হাদিছ নং: ১৩৭৫)। তথা তিনি শুরুতেই তারাবী পড়িয়েছেন।

আবদুর রজ্জাক বর্ণনা করেন, “আবদুর রহমান বিন আসওয়াদ থেকে বর্ণিত: তাহাজ্জুদ ঘুমের পরে।” (আবদুর রজ্জাক, প্রাগুক্ত, হাদিছ নং: ৪৭৩০)।

৪. তাহাজ্জুদ মক্কাতেই ফরয হয়েছিল। পরে তা রহিত হলো। কিন্তু তারাবী সুন্নাত হলো মদীনাতে দশম হিজরিতে। ৫. তারাবী প্রকাশ্য পড়া উত্তম। আর তাহাজ্জুদ গোপনে পড়া উত্তম। কারণ তারাবী শিআরে ইসলাম। আর তাহাজ্জুদ শিআরে আউলিয়া।

৬. রমযানে তারাবী পড়া সুন্নাত; আর তাহাজ্জুদ পড়া নফল: আবু দাউদ, তিরমিযী, মুসলিম প্রমুখ বর্ণনা করেন, “হযরত সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত: আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ শাবান মাসের শেষ দিনে ভাষণ দিলেন, আর বললেন, হে লোকসকল! তোমাদেরকে একটি মহান মাস ছায়া দিচ্ছে যা বরকতময় মাস। এমন মাস যার একটি বিশেষ রাতের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ এর রোজাকে ফরজ করেছেন ও রাত্রি জাগরণকে নফল করেছেন।

যে ব্যক্তি তাতে একটি ভালো আমল করবে সে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করার পুণ্য পাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো ফরজ আদায় করবে সে অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায় করার পুণ্য পাবে। তা ধৈর্যের মাস।

আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত। তা অপরের সাথে কল্যাণের মাস। এমন মাস যাতে মুমিনের রিজিক বেড়ে যায়। যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার পাপসমূহ মুছে দেওয়া হবে ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে ও তার জন্য ইফতারকারির সমপরিমাণ পুণ্য তার থেকে ঘাটতি ব্যতীত প্রদান করা হবে।

তখন সাহাবীগণ বললেন, আমাদের প্রত্যেকে তো রোজাদারকে ইফতারী করানোর সক্ষম রাখি না। তখন তিনি বলেন, আল্লাহ সেই পুণ্য প্রদান করবেন ঐ ব্যক্তিকেও যে কাউকে একটি খেজুর বা সামান্য পানি বা দুধের পেষ্ট দ্বারা ইফতার করাবে। তা এমন মাস যার শুরু রহমত, মধ্যম মাগফিরাত ও শেষ জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস।

যে ব্যক্তি তার মামলুক বা কর্মচারী থেকে কাজ হালকা করবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান করবেন। তাই তোমরা চারটি কাজ বেশি করো: দুটি কাজ দ্বারা তোমরা তোমাদের রবকে সন্তুষ্ট করবে। আর দুটি কাজ যা তুমি না করার উপায় নেই। যে দুই কাজ দ্বারা তোমরা তোমাদের রবকে সন্তুষ্ট করবে তা হলো, সাক্ষি দেওয়া আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই ও এর কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করবে।

আর যে দুই কাজ ছাড়া তোমাদের কোনো উপায় নেই তা হলো, তোমরা আল্লাহর নিকট জান্নাত তালাশ করবে ও জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাইবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে উদরফুর্তি করবে আল্লাহ তাকে আমার হাউজ থেকে এমন পানি পান করাবে জান্নাতে প্রবেশ পর্যন্ত সে কখনো পিপাসার্ত হবে না।” (আবু দাউদ হাদিছ নং: ১৩৭১; তিরমিযী, হাদিছ নং: ৮০৮; মুসলিম, হাদিছ নং: ৭৫৯)

ইমাম নাসায়ী ও আহমদ বর্ণনা করেন, “হযরত নযর বিন শায়বান থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি আবু সালামা বিন আবদুর রহমানের সাক্ষাত করলাম। আমি তাকে বললাম, তুমি আমাকে তোমার পিতা থেকে শ্রবণ করা হাদিছ বর্ণনা কর; যা সে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে রমজানের ব্যাপারে শ্রবণ করেছে। তিনি বললেন, হ্যাঁ আমাকে আমার পিতা রাসূলুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন।

তিনি ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ রমজানের রোজা ফরজ করেছেন আর আমি এর কিয়ামকে সুন্নাত করলাম। তাই যে ব্যক্তি রমজানে রোজা রাখবে ও ঈমান ও পুণ্যের আশায় কিয়াম তথা তারাবী পড়বে সে পাপ থেকে মায়ের গর্ভ থেকে নতুন জন্ম লাভের মত নিষ্পাপ হয়ে যাবে।” (আহমদ, হাদিছ নং: ১৬৬০; নাসায়ী, হাদিছ নং: ২২০৯)

আনোয়ারশাহ কাশ্মিরি (রহ.) বলেন, “সাধারণ আলিমগণ বলেন, তারাবী ও তাহাজ্জুদ দুটি নামাজ। আমার নিকট পছন্দ হলো, তা একটি নামাজ। যদিও উভয়ের গুণাবলী ভিন্ন। যেমন তারাবী অনিয়মিত পড়া, জামাতে আদায় করা, রাতের শুরুতে আদায় করা, সেহরী পর্যন্ত আদায় করা। আর তাহাজ্জুদ শেষ রাতে আদায় করা জামাতবিহীন। গুণাবলীর ভিন্নতার কারণে ভিন্ন নামাজ বলা উচিত নয়; বরং তা এক নামাজ যদি শুরুতে আদায় করা হয় তা তারাবী আর যদি শেষে আদায় করা হয় তা তাহাজ্জুদ।

আর গুণাবলীর ভিন্নতার কারণে দুটি নাম দেওয়াতে অসুবিধে নেই। কেননা, নাম ভিন্ন হলে উম্মত তাতে একমত হলে কোনো সমস্যা নেই। আর ভিন্ন প্রমাণিত হতো যদি নবী (সা.) তারাবী আদায় করার পর যদি তাহাজ্জুদ পড়া প্রমাণিত হতো।” (ফয়যুল বারী, খ. ৪, পৃ. ২৩)।

সার কথা হলো তারাবী ও তাহাজ্জুদ এক নামাজ নয়। বরং তা ভিন্ন ভিন্ন নামাজ। তাহাজ্জুদ বারো মাস আদায় করা হয় আর তারাবী শুধু এক মাস আদায় করা হয়। তবে তারাবী যদি রাতের শুরুতে আদায় না করে শেষ রাতে আদায় করে তখন তাহাজ্জুদ তারাবীতে অনুপ্রবেশ করবে। দুটির হক আদায় হয়ে যাবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

-এটি


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ