বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫ ।। ২১ কার্তিক ১৪৩২ ।। ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যৌন হয়রানি: নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন ৯ জেলায় জনবল নিয়োগ দিচ্ছে আকিজ গ্রুপ  ‘আমেরিকা কিছুটা সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে’, জোহরান মামদানির জয়ে ট্রাম্পের প্রথম প্রতিক্রিয়া চব্বিশের যুবশক্তিকে নিয়েই ইনসাফের বাংলাদেশ গড়তে চাই মাসনা মাদরাসার  বার্ষিক মাহফিল—আত্মশুদ্ধি ও রূহানিয়্যাতের মহামিলন সৌদিতে সভা-সমাবেশ নিয়ে কঠোর সতর্কতা বাংলাদেশ দূতাবাসের ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় জোহরান মামদানির প্রধান উপদেষ্টার কাছে জামায়াতে ইসলামীসহ ৮ দল স্মারকলিপি দেবে আজ প্রথম মুসলিম দেশ হিসেবে তামাক নিষিদ্ধের ঘোষণা দিল মালদ্বীপ 'বাঙ্গরাবাজার থানা’ উপজেলা হলে খুলে যাবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

'বাঙ্গরাবাজার থানা’ উপজেলা হলে খুলে যাবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুনীরুল ইসলাম
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত বাঙ্গরাবাজার থানা। দীর্ঘদিন ধরেই এলাকার জনগণ এই থানাকে পূর্ণাঙ্গ উপজেলায় রূপান্তরের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু উপজেলা বাস্তবায়নের কার্যক্রম অনেকদূর এগিয়ে গেলেও এখনও ঘোষণা করা হয়নি। ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত বাঙ্গরাবাজার থানা ভৌগোলিকভাবে বিস্তীর্ণ, জনবহুল এবং অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় একটি অঞ্চল। সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রশাসনিক সুবিধা, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, যোগাযোগ ও স্থানীয় উন্নয়নের স্বার্থে এ থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা শুধু প্রয়োজন নয়, বরং যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও থানা পরিচিতি

মুরাদনগর কুমিল্লা জেলার একটি উপজেলা। এতে মোট ২২টি ইউনিয়ন রয়েছে। যার মোট আয়তন ৩৪০.৯৩ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী) ৬,৬৭,৩২০ জন। এর মধ্যে বাঙ্গরাবাজার থানা ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর অনুমোদিত হয়। এই থানার আয়তন ১৮৯ বর্গ কিলোমিটার। এই থানাধীন ১০টি ইউনিয়ন হলো : ১ নং শ্রীকাইল, ২ নং আকুবপুর, ৩ নং আন্দিকোট, ৪ নং পূর্বধইর পূর্ব, ৫ নং পূর্বধইর পশ্চিম, ৬ নং বাঙ্গরা পূর্ব, ৭ নং বাঙ্গরা পশ্চিম, ৮ নং চাপিতলা, ১২ নং রামচন্দ্রপুর উত্তর এবং ২২ টনকি।

প্রশাসনিক সেবা হবে জনগণের দোরগোড়ায়

বর্তমানে মুরাদনগর উপজেলা সদর থেকে বাঙ্গরাবাজারের দূরত্ব প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার। প্রশাসনিক কাজে সাধারণ মানুষকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়, ফলে সময় ও অর্থের অপচয় হয়। যদি বাঙ্গরাবাজার উপজেলায় উন্নীত হয়, তাহলে নাগরিক সেবা, ভূমি অফিস, সমাজসেবা, মহিলা বিষয়ক কাজ, কৃষি সম্প্রসারণসহ প্রশাসনিক দপ্তরগুলো স্থানীয়ভাবে পাওয়া যাবে। মানুষকে আর উপজেলা সদরে যেতে হবে না। ফলে সময়, অর্থ ও শ্রমের সাশ্রয় ঘটবে। স্থানীয় সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হবে। এক কথায়, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ঘটলে জনগণের নাগালেই পৌঁছে যাবে সরকারি সেবা।

শিক্ষাক্ষেত্রে আসবে নবজাগরণ

বাঙ্গরাবাজার অঞ্চলটি শিক্ষার দিক থেকে বেশ সম্ভাবনাময়। এখানে ইতোমধ্যে রয়েছে অনেক কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদরাসা। তবে উপজেলাভিত্তিক শিক্ষা অফিস না থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যাপ্ত তদারকি ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উপজেলায় উন্নীত হলে, নতুন সরকারি কলেজ ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুযোগ তৈরি হবে। শিক্ষা অফিস স্থাপন হলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও পরীক্ষার তদারকি বাড়বে। নারী শিক্ষার সুযোগও আরও প্রসারিত হবে। ফলে অচিরেই এই এলাকা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে পারে।

স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাবে গ্রামীণ দরজায়

বর্তমানে পুরো বাঙ্গরা অঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা নির্ভর করে সীমিত কয়েকটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ক্লিনিকের ওপর। গুরুতর রোগীর চিকিৎসার জন্য তাদের কুমিল্লা শহর, মুরাদনগর সদর কিংবা দেবিদ্বারে যেতে হয়। এখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থাপন করা হলে আধুনিক হাসপাতাল ও মাতৃসদন কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ হবে, চিকিৎসকদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ ও দায়িত্ব নিশ্চিত করা যাবে, স্থানীয়ভাবে জরুরি অ্যাম্বুলেন্স ও ল্যাব সুবিধা পাওয়া যাবে। এর ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমবে এবং সাধারণ জনগণ স্বাস্থ্যসেবার নতুন দিগন্তে প্রবেশ করবে।

কৃষিতে আসবে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধি

বাঙ্গরাবাজার অঞ্চল কৃষিনির্ভর। ধান, পাট, আলু, শাকসবজিসহ নানা ফসলের উৎপাদনে এ এলাকা সমৃদ্ধ। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ দূরে থাকায় কৃষকরা অনেক সময় যথাযথ পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পান না। উপজেলায় উন্নীত হলে কৃষি অফিস ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকি বাড়বে, আধুনিক কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সেচ প্রকল্প ও বীজ ভাণ্ডার স্থাপনের সুযোগ তৈরি হবে, কৃষি ঋণ ও প্রণোদনা কার্যক্রম সহজলভ্য হবে। ফলে স্থানীয় কৃষকরা হবে আত্মনির্ভরশীল এবং কৃষি উৎপাদনে আসবে বিপ্লব।

যোগাযোগব্যবস্থায় আসবে আমূল পরিবর্তন

বাঙ্গরাবাজার একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র, যেখান থেকে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার সংযোগ রুট রয়েছে। কিন্তু সড়কগুলোর অবস্থা এখনও কাক্সিক্ষত মানের নয়। উপজেলায় উন্নীত হলে সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ পাওয়া যাবে। গ্রামীণ রাস্তা, বাজার সংযোগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগামী পথগুলোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। স্থানীয় ব্যবসা ও পণ্য পরিবহনে সুবিধা বাড়বে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে। যোগাযোগের উন্নতি মানেই জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন- এই সত্যটি এখানেও প্রযোজ্য হবে।

শিল্প ও বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা

বাঙ্গরাবাজার দীর্ঘদিন ধরেই একটি সমৃদ্ধ বাজার ও ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। উপজেলায় রূপান্তরিত হলে স্থানীয় বাণিজ্যে সরকারি নজরদারি ও সহায়তা বাড়বে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি হবে। স্থানীয় তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। ব্যাংক, বিমা ও সরকারি দপ্তরের মাধ্যমে ব্যবসায়িক সেবা সহজ হবে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং স্থানীয় অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।

নারী উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার হবে

উপজেলা পর্যায়ে নারী উন্নয়ন কর্মকর্তা, মহিলা বিষয়ক দপ্তর, সমাজসেবা অফিস স্থাপিত হলে নারীরা পাবেন সরাসরি সরকারি সহায়তা। নারী উদ্যোক্তা ও স্বনির্ভরতা প্রকল্পে অংশ নিতে পারবেন। বিধবা, প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের ভাতা বিতরণ আরও স্বচ্ছ হবে। শিশু ও নারীর সুরক্ষা কার্যক্রম তদারকি সহজ হবে। ফলে গ্রামীণ পরিসরে সামাজিক ন্যায্যতা ও নিরাপত্তা জোরদার হবে।

যুবসমাজ ও খেলাধুলায় আসবে প্রাণচাঞ্চল্য

নতুন উপজেলা হিসেবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রীড়া উন্নয়ন অফিস, মাঠ-স্টেডিয়াম, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব হবে। এতে স্থানীয় তরুণরা খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে। মাদক ও বেকারত্ব হ্রাস পাবে। যুবশক্তি সৃজনশীল পথে আগাবে এবং সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হবে।

ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতি দৃঢ় হবে

এই অঞ্চলে মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীলভাবে সহাবস্থান করছে। নতুন প্রশাসনিক কাঠামো এই সম্প্রীতির ধারাকে আরও সুসংহত করবে। উপজেলার মাধ্যমে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, অনুদান ও সামাজিক কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।

স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন গতি আসবে

নতুন উপজেলা গঠনের ফলে স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। জনপ্রতিনিধিরা স্থানীয় সমস্যার সমাধানে আরও সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারবেন। নতুন উপজেলা পরিষদ গঠনের ফলে জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে, যা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করবে।

সময় এসেছে উন্নয়নের নতুন অধ্যায়ের

বাঙ্গরাবাজার থানা এখন শুধু প্রশাসনিক নাম নয়; এটি কুমিল্লার উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র। এই অঞ্চল শিক্ষা, কৃষি, বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও জনবহুলতার দিক থেকে ইতোমধ্যেই উপজেলাযোগ্য সব মানদণ্ড পূরণ করেছে। তাই প্রশাসনিক উন্নীতকরণ শুধু একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়- এটি হবে এলাকার মানুষের প্রাপ্য অধিকার। বাঙ্গরাবাজারকে উপজেলায় উন্নীত করা হলে তা শুধু কাগজে কলমে নয়, বাস্তবে এক বিশাল পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবে- যেখানে শিক্ষা-চিকিৎসা-অর্থনীতি-যোগাযোগ একসঙ্গে এগিয়ে যাবে, আর উন্নয়নের স্রোতধারা ছুঁয়ে যাবে মুরাদনগরের উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি ঘর।
আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত সময়ের মধ্যে বাঙ্গরাবাজার থানাকে উপজেলায় উন্নীত করে এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন। মহান আল্লাহ সুমতি দান করুন। আমিন!

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম; পরিচালক, সম্পাদনা কেন্দ্র; নাগরিক, বাঙ্গরাবাজার থানা

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ