সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ।। ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ৩০ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
স্পেন জমিয়তের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত ভারতকে ১৯৬৫ সালের মতো জবাব দেবে পাকিস্তান: মাওলানা ফজলুর রহমান ‘৩ মে’র মহাসমাবেশ হবে তৌহিদি জনতার গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক’ ৩ মের মহাসমাবেশ সফল করতে হেফাজত আমিরের আহ্বান হজ অ্যাপ ‘লাব্বাইক’ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা ইসলামবিরোধী কবিতা লিখে নির্বাসিত, ৫০ বছরেও ফিরতে পারেননি দেশে তিন পুরুষের জমিয়ত উত্তরসূরী মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী আজ হজ ফ্লাইট উদ্বোধন করবেন ধর্ম উপদেষ্টা হেফাজতের খুলনা মহানগরী সভাপতি মাওলানা সাখাওয়াত, সম্পাদক গোলামুর রহমান যুদ্ধের মাঝে যৌথ অস্ত্র উৎপাদন: ভারত-ইসরায়েল সামরিক সম্পর্কের বিবর্তন

আলেমসমাজকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে: এটার আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি তাকি উসমানি।।

আলেম সমাজকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, এমন শ্লোগান আজ কাল হর-হামেশাই শােনা যাচ্ছে। জাতীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মুখ থেকে প্রায়ই উচ্চারিত হচ্ছে এই বাক্য। উঁচু স্তরের কোন সাধারণ মজলিসে ধর্মীয় আলােচনা আসলেই এখন এই বাক্যের প্রতিধ্বনি শােনা যায়। সমাজের যেই শ্রেণীর মানুষ আজ প্রগতিবাদের আড়ালে ইসলামের সর্বসম্মত মূলনীতি ও বিধানকে কাটছাট করার কাজে নিরত আছেন, উলামায়ে হককে তারা তাদের পথের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক মনে করছেন।

উলামায়ে হকের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া এবং তাদের সমালােচনা করাকেই তারা স্বীয় জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে মনে করেন। এ কারণে, নবীন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার জন্য 'যুগচাহিদা’র অস্পষ্ট বাক্যটিকে তারা উৎকৃষ্ট শ্লোগান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এর সাহায্যে তারা আজ জাতির কাছে প্রতিনিয়ত আপিল জানচ্ছেন, আলেমগণ উন্নতি-অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় এবং সমাজের বােঝা স্বরূপ। অতএব তাদের কোন কথাই গ্রহণযােগ্য নয়।

এই সকল লােকের বিষয় আমরা আল্লাহর উপর ন্যস্ত করছি, যিনি সকলের মনের যাবতীয় গােপন রহস্য সম্পর্কে অবগত। তবে সমাজে এমন কিছু লােক আছেন, যারা আলেমদের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও ধারণা পােষণ করেন যে, তারা আধুনিক যুগ-চাহিদা সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন, তাই তারা প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বিষয়ের বিরােধিতা করেন।

এমন লােকদের সম্পর্কে কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি। তবে আলােচনার পূর্বে আমাদের নিবেদন হল, বাস্তবিকই যদি তারা নিষ্ঠার সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের মঙ্গলকামী হয়ে থাকেন, তাহলে অত্যন্ত স্থির ও শান্ত মেজাজে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করবেন। এবং কিছু সময়ের জন্য আবেগপূর্ণ শ্লোগানের মােহ থেকে মস্তিষ্ককে মুক্ত করে একটু ভাবতে চেষ্টা করবেন যে, 'যুগ-চাহিদার প্রকৃতস অর্থ কী? তা পূর্ণ করার প্রকৃত পন্থা ও পদ্ধতিই বা কী? এ ব্যাপারে।

আলেমদের উপর যে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, ঘটনাবহুল পৃথিবীতে তার বাস্তবতা কতটুকু? সর্বপ্রথম নির্ধারণ করার বিষয় হল, যুগ-চাহিদা পুরনের অর্থ কী? আমার মনে হয় রাত-দিন যারা যুগ-চাহিদার গুরুত্বের সবক দানে নিরত তাদের মাথায়ও এ সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারণা নেই। সারাক্ষণ তারা এই অস্পষ্ট শ্লোগান দিয়ে আসছেন যে, উলামায়ে কিরাম যুগ-চাহিদার পরিপন্থী। কিন্তু তারা কখনাে পরিষ্কার করে বলেননি, সেই চাহিদাটা কী; যার বিরোধিতায় আলেমগণ উঠে-পড়ে লেগেছেন।

যুগ-চাহিদার অর্থ যদি মুসলিম রাষ্ট্রগুলাের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যাবতীয় উপকণ দ্বারা সমৃদ্ধি অর্জন হয়, যা ব্যতীত বর্তমান বিশ্বে স্বাধীনভাবে শ্বাস নেয়া সম্ভব নয়, তাহলে নিঃসন্দেহে এটা সময়ের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দাবী। কিন্তু আল্লাহর ওয়াস্তে কেউ আমাদেরকে এ কথা বলবেন কি যে, কোন্ আলেমে দ্বীন যুগের এমন গুরুত্বপূর্ণ দাবীকে নাজায়েয বলেছেন?

কখন কোন্ আলেম ফাতওয়া দিয়েছেন যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ময়দানে অগ্রগতির চেষ্টা করা হারাম, নাজায়েয বা অর্থহীন? নিকট অতীতে বিজ্ঞান কী রূপ বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করেছে। দেখতে-দেখতে নতুন আবিষ্কারের ঢের লেগে গেছে। এসব আবিস্কৃত বিষয়সমূহের মধ্যে কোন্ কোন্‌টির আলেমগণ বিরােধিতা করেছেন।

বিদ্যুৎ, তার, টেলিফোন, টেলিপ্রিন্টার, ওয়্যারলেস, রেডিও, টেপরেকর্ডার, গাড়ি, মটর, হাওয়াই জাহাজ, স্টীমার, রেল গাড়ি; যুদ্ধাস্ত্রের মাঝে ট্যাংক, কামান, বিভিন্ন প্রকার বােমা, ফাইটার, সাবমেরিন, রকেট, মিসাইল, রাডার; শিল্প ক্ষেত্রে নানা রকমের মেশিন, কারখানা; কৃষি ক্ষেত্রে ট্রাকটর, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ঔষধ; চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অপারেশনের যন্ত্রপাতি, রােগ নির্ণয়ের জন্য যন্ত্রপাতি; শিক্ষা ক্ষেত্রে কল, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞান, গণিত, ভূগােল, জ্যোতির্বিদ্যা, অর্থনীতি, রাষ্ট্র বিজ্ঞান ইত্যাদির মাঝে কোটির ব্যাপারে আলেমগণ বিরােধিতা করেছেন বা তার উন্নতি ও অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন?

আমাদের উন্নয়নশীল দেশের বিশ বছরের ইতিহাস আমাদের সামনে। এই সময়ে উলামায়ে হক ও দ্বীনদার শ্রেণীর ঐকান্তিক প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশ শিল্প ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করে বহু দূর এগিয়ে গেছে। বড় বড় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এই সময়ের মাঝে বাস্তবায়িত হয়েছে। বড় বড় কারখানা তৈরি হয়েছে। বিশাল দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বিশিষ্ট সড়ক নির্মিত হয়েছে।

পানি প্রবাহিত করার জন্য বহু খাল খনন করা হয়েছে। নদীর উপর বাধ নির্মাণ করা হয়েছে। যোগাযােগ মাধ্যমগুলাের পুরাতন ব্যবস্থাপনা আস্তে-আস্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ের কলেজ-ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অসংখ্য অনাবাদী এলাকা আবাদ হয়েছে। এমন নির্বোধ লােক কে? যে এই উন্নতিতে অসন্তুষ্ট? একজন আলেমে দ্বীনের নাম বলুনতাে, যিনি বলেছেন, বস্তুগত উন্নতির এসব পন্থা অবলম্বন করাে না, দেশে কুশলী বৈজ্ঞানিক তৈরি করাে না, মানুষকে ইঞ্জিনিয়ারিং এর উচ্চ শিক্ষা দিও না, কারখানা নির্মাণ।

করাে না, সড়ক, ব্রীজ, খাল ও বাঁধ নির্মান করাে না, দেশের আত্মরক্ষার জন্য উন্নত সমরাস্ত্র তৈরি করার চেষ্টা করাে না, সৈন্যদের আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র চালানাের জন্য প্রশিক্ষণ দান করাে না, জীবন যাত্রার উন্নত মাধ্যমগুলাে অবলম্বন করাে না বা নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিও না?

কোন আলেমে দ্বীন যদি এটা না বলে থাকেন– মূলতঃ কেউ এমন কথা বলতে পারেনা। তাহলে উলামায়ে হকের উপর ভিত্তিহীন এই অপবাদকে বিদ্বেষ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে ? উলামায়ে হকের মধ্যে আলহামদুলিল্লাহ! অসংখ্য আলেমের কথা আমাদের জানা আছে, যাদের আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু বিদেশ নয় স্বদেশ।

তাদের মনের সবচেয়ে বড় কামনা হল, ইসলামের সিরাতে মুস্তাকিমের উপর অটল থেকে জাগতিক দিক থেকেও দিন-দিন উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হােক। এ কারণে, এই সকল আলেমগণ একদিকে যেমন মুসলমানদেরকে তাগিদ দিয়েছেন যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নত প্রশিক্ষণ আমাদের দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়; এই দায়িত্ব পালনে যদি আমরা অবহেলা করি, তাহলে আল্লাহর দরবারে আমরা অপরাধী হব; অন্য দিকে তাদের রাত-দিনের দু'আ এই কাজের জন্যই বরাদ্দ যা একমাত্র সর্বজ্ঞ মহান আল্লাহই জানেন।

সংক্ষিপ্তভাবে আমরা এখানে বর্তমান যুগের এমন কিছু উলামায়ে কিরামের উদ্ধৃতি পেশ করব, যাদের উপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিরােধিতার অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানে আলেমগণের মাঝে শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ)ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পিছনে তার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে ঢাকার এক কনফারেন্সে পাকিস্তানের আলেমগণের পলিসি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন।

“নেতৃবৃন্দ আমাদের সাথে যেরূপ আচরণই করুন, আমরা খালেছ আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ইসলাম ও মুসলমানদের উন্নতি-অগ্রগতির জন্য আমাদের নবগঠিত রাষ্ট্রকে শক্তিশালী ও নিরাপদ করার প্রচেষ্টায় সামান্যতম অবহেলা করব না।" (সভাপতির ভাষণ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম কনফারেন্স, ১০ইফেব্রুয়ারী ১৯৪৯, পৃ: ৩, মুদ্রণ করাচী)।

ঐ ভাষণেই অন্যত্র তিনি বলেন, “আমাদের স্বীয় সামর্থের শেষ বিন্দু পর্যন্ত জাগতিক বস্তুগত মাধ্যমগুলাে সংগ্রহে অবহেলা করা উচিৎ নয়, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের শত্রুর মনােবলকে ভেঙ্গে দিতে পারি এবং তাদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে পারি। কেননা, এটা কুরআন কারীমের সুস্পষ্ট নির্দেশ! এর অন্তর্ভূক্ত।” (ঐ পৃ: ২৩, ২৪)

আরাে বলেন, আমার মতে আমাদের সকল কল্যাণ ও কামিয়াবীর রহস্য এই চার শব্দের মধ্যে নিহিত? ১. ধৈর্য ও সহনশীলতা, ২. তাকওয়া, ৩. ঐক্য। ৪, সামর্থ অনুযায়ী শক্তি সঞ্চয়। যার সার কথা হল, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে আল্লাহর সাথে নিজ সম্পর্ক নির্ভেজাল রাখতে হবে, যাতে তার সাহায্যপ্রাপ্ত হওয়া যায়। আর সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বীয় সামর্থের শেষ বিন্দু পর্যন্ত এমন শক্তি সঞ্চয় করতে হবে যাতে করে ইবলিসের বাহিনীর সকল শক্তি-সাহস ভেঙ্গে যায়।

-এটি


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ