এক সময়ের জমজমাট খুলনার ‘চামড়াপট্টি’ আজ হারিয়েছে তার চিরচেনা জৌলুস। ঐতিহ্যবাহী শেখপাড়ার শের-ই-বাংলা রোড এখন আর কাঁচা চামড়ার স্তূপ, গন্ধ কিংবা ঈদের সময়কার কর্মচাঞ্চল্যে মুখরিত নয়। কালের বিবর্তনে মুখ থুবড়ে পড়েছে খুলনার চামড়া ব্যবসা।
এলাকার অর্ধশতাধিক পুরাতন ব্যবসায়ী অনেকেই পেশা বদলেছেন। কেউ খুলেছেন লোহা-লক্কড়ের দোকান, কেউ বসিয়েছেন লেদ মেশিন, আবার কেউ হয়ে গেছেন কবুতর-পাখি বা অ্যাকুরিয়াম ব্যবসায়ী।
তবে অনেকেই এখনও পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে চামড়া ব্যবসার সঙ্গে লেগে আছেন। কিন্তু তারা বলছেন, এই ব্যবসা আর আগের জায়গায় নেই—বিশেষত ঢাকার ট্যানারিতে চামড়া দিয়ে পুঁজির বড় অংশ হারানোর পর থেকেই পতন শুরু।
খুলনার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী মো. বাবর জানান, “২০১৩ সালে ঢাকার আনোয়ার ট্যানারিতে আমরা প্রায় আড়াই কোটি টাকার চামড়া সরবরাহ করেছিলাম। আজ পর্যন্ত মাত্র ১০ লাখ টাকা ফেরত পেয়েছি। এতে আমাদের অন্তত ৪-৫টি পরিবার চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে।”
তিনি জানান, পাওনা টাকা চাওয়ার পর অনেকেই নাজেহাল হয়েছেন, এমনকি প্রভাবশালী পরিবার ব্যবহার করে হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে যেন টাকা না চাওয়া হয়।
এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও ঈদুল আজহা ঘিরে কেউ কেউ নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন। খুলনা জেলা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কার্ত্তিক ঘোষ বলেন, “ঈদের দিন থেকে পরবর্তী সাত দিন চামড়া প্রসেসিংয়ের জন্য শের-ই-বাংলা রোডে জেলা প্রশাসক ও কেএমপি কমিশনারের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। আশা করি, তিন দিনের মধ্যেই রাস্তা পরিষ্কার করে কাজ শেষ করা যাবে।”
চামড়া সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ হিসেবে এবার মাদরাসা ও এতিমখানাগুলোতে বিনামূল্যে লবণ বিতরণ করছে সরকার। খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, “নগরী ও জেলার ১৭৩টি মাদরাসা ও এতিমখানায় ৯৭ হাজার ৪৫৯ কেজি লবণ বিতরণ করা হয়েছে।”
তবে অনেক প্রতিষ্ঠান চামড়া সংরক্ষণে আগ্রহী নন। ফজলুল উলুম বহুমুখী মাদ্রাসা ও এতিমখানার নায়েবে মুহতামিম মুফতি মাহবুবুর রহমান এবং তা’লীমুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা এএফএম নাজমুস সউদ জানান, “সংরক্ষণের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব থাকায় কাঁচা অবস্থাতেই চামড়া বিক্রি করাই বাস্তবসম্মত মনে করছি।”
এদিকে, সুপারেক্স লেদারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ ভূঁইয়া বলেন, “আমি বিভিন্ন মাদরাসার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
খুলনার চামড়াপট্টির বর্তমান চিত্র যেন এক হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের কঙ্কালসার ছায়া। কোথায় সেই ঈদের দিন ভোর থেকে রাত অবধি ক্রয়-বিক্রয় আর প্রসেসিংয়ের ধুম, এখন অনেকটাই নিস্তব্ধ।
তবু কেউ কেউ আশা ছাড়ছেন না। তাদের বিশ্বাস, সরকার ও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা থাকলে খুলনার ঐতিহ্যবাহী চামড়া ব্যবসা আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে।
এসএকে/