বিশেষ প্রতিনিধি
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এখন এদেশের কোটি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা এবং নির্ভরতার প্রতীক। ইসলামবিরোধী যেকোনো ঘটনা ঘটলে এর প্রতিবাদে সবার আগে যে সংগঠনটির গর্জে ওঠার বিষয়টি ধর্মপ্রাণ মানুষেরা প্রত্যাশা করে, সেটি হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। নানা কারণে সংগঠনটি বিভিন্ন সময় হোচট খেলেও এখনো সবাই প্রত্যাশা করে হেফাজত তার স্বকীয়তা বজায় রাখবে, মানুষের আস্থা ও নির্ভরতার ঠিকানায় পরিণত হবে। যেমন সদ্য সুপারিশকৃত নারী সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সবার প্রত্যাশা ছিল হেফাজত কর্মসূচি দেবে। জনপ্রত্যাশাকে মূল্যায়ন করে হেফাজত সেই কর্মসূচি দিয়েছে। মাঝখানে কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে কারও কারও বিতর্কের নিশানায় পড়া হেফাজত আবার প্রশংসায় ভাসতে শুরু করেছে।
হেফাজতে ইসলামের জন্মটাই মূলত ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদের প্রত্যয় নিয়ে। দেশে অনেক সংগঠন থাকলেও একটা সময় আলেমরা সম্মিলিতভাবে এর প্রয়োজন অনুভব করেন। সেখান থেকেই মূলত যাত্রা করে হেফাজতে ইসলাম। গত ১৫ বছর ধরে সংগঠনটি নানা চড়াই-উৎরাই পার করে এগিয়ে চলছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে বড় বড় তিনটি ঘটনা ঘটে। তিনটি ঘটনাই এদেশের মুসলমানদের জীবনাচার এবং ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেগুলো হলো জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯, নারীনীতি ২০১১ এবং সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস’ তুলে দেওয়া। একদিকে জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে ধর্মশিক্ষাকে আলাদাকরণ, অন্যদিকে কুরআনবিরোধী আইন প্রণয়ন, তার সঙ্গে সংবিধানের সূচনা থেকে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তুলে ফেলার ষড়যন্ত্র—সব মিলিয়ে এদেশের মুসলিমদের আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
এর বিরুদ্ধে আলেমদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদও হচ্ছিল বিচ্ছিন্নভাবে। ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোও নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। তবে এটা খুব একটা কার্যকরী হচ্ছিল না। ঠিক তখনই ১৭ জানুয়ারি ২০১০, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর আমন্ত্রণে হাটহাজারী মাদরাসায় একত্রিত হন চট্টগ্রামের বড় বড় মাদরাসার শিক্ষক এবং মুহতামিমরা।
এই প্রেক্ষাপটে কীভাবে প্রতিবাদ জানানো যায়, কীভাবে ইসলামবিরোধিতার স্রোতকে ঠেকানো যায় সেটা নিয়ে আলোচনা হয়। তবে সেদিন চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রাথমিক আলোচনার পর শেষ হয় বৈঠক।
১৯ জানুয়ারি আবারো বৈঠক আহ্বান করা হয়। বৈঠকে আল্লামা আহমদ শফী রহ. প্রস্তাব করেন, ‘লালদিঘির ময়দানে আমরা একটি সমাবেশ করতে চাই। সমাবেশ থেকে প্রতিবাদ জানানো হবে।’মাওলানা আবদুল হালীম বুখারী রহ. তখন জানতে চান, ‘কোন ব্যানারে সমাবেশ করা হবে। যেকোনো একটি ব্যানারে তো সমাবেশ করতে হবে।’ আলোচনায় একটি সংগঠনের প্রস্তাব উঠে আসে। যেটি হবে নিরেট অরাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনের ব্যানারেই ২৪ জানুয়ারি লালদিঘির ময়দানে সমাবেশ হবে।
সেই বৈঠকে উপস্থিত একজন জানান, সংগঠনের নাম হিসেবে প্রথমে পুরনো কয়েকটি ইসলামি সংগঠনের নাম উঠে আসে। তবে শেষ পর্যন্ত সবাই একমত হন, নতুন নাম হলেই ভালো হয়। তাহলে পুরনো সংগঠনের নেতিবাচক প্রভাবগুলো থাকবে না। মাওলানা আবদুল হালীম বুখারী রহ. সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন, ‘সংগঠনের নাম হোক হেফাজতুল ইসলাম।’মাওলানা সুলতান যওক নদভী সাহেব বললেন, ‘হেফাজতুল ইসলাম নামটি আরবি। মানুষের উচ্চারণে সমস্যা হতে পারে। যদি নামটি ফার্সিতে ‘হেফাজতে ইসলাম’ বলা হয়, তাহলে সমস্যাটা থাকবে না।
‘হেফাজতে ইসলাম’ নামটিই গৃহীত হলো। সবাই আল্লামা আহমদ শফী রহ.-এর কাছে আবেদন করলেন, ‘আপনি হবেন হেফাজতে ইসলামের আমির।’ তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার বয়স পড়ে গেছে। গায়ে এত শক্তিও নেই এবং সংগঠন পরিচালনার তেমন অভিজ্ঞতাও নেই। মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী হোক আমির।’ মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সাহেব রাজি হলেন না। বরং বললেন, ‘হজরত, আপনিই আমির হবেন। আমি না হয় আপনার সহকারী হিসেবে থাকব।’
জানা যায়, ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না মুফতি আবদুর রহমান রহ.। তাঁকে বৈঠক থেকে ফোন করে জানানো হলো, ‘আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন করা হয়েছে। সিনিয়র নায়েবে আমির হিসেবে আপনাকে রাখতে চাচ্ছি।’ তিনি বললেন, ‘আল্লামা আহমদ শফী সাহেব হুজুর যে কাজই করেন, আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে তাঁর সঙ্গে কাজ করব।’ এভাবেই যাত্রা করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
তবে ২০১৩ সালে নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়ে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের মাধ্যমে হেফাজত প্রথম জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনায় আসে। এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এদেশের নতুন একটি ইসলামি শক্তি হিসেবে জানান দিতে সক্ষম হয়।
এসএকে/