শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫ ।। ১১ শ্রাবণ ১৪৩২ ।। ১ সফর ১৪৪৭


আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে নবীজির জীবনাদর্শের অনুকরণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| রমযান রব্বানী ||

মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু আলোকবর্তিকাতুল্য ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে, যাঁরা অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে আলো দেখিয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে আলোর দীপ্তি সর্বজনীন এবং সর্বকালের জন্য কার্যকর, সে আলো একমাত্র নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন থেকেই বিকিরিত হয়েছে। তাঁর চরিত্র, জীবনযাপন, সমাজ সংস্কারের ধারা ও মানবিক নীতিবোধ- সবকিছুই আজও আদর্শ সমাজ গঠনের অনবদ্য রূপরেখা।

আরবের জাহেলিয়াত যুগে সমাজ ছিল নৈতিকতাহীন, বিভ্রান্ত ও অনাচারে নিমজ্জিত। সেই সমাজে নারী ছিল অপমানিত, গরিব ছিল বঞ্চিত, শক্তিমান ছিল সীমালঙ্ঘনকারী। এমন এক অবক্ষয়ের সময়ে আল্লাহর প্রেরিত নবী মুহাম্মাদ (সা.) যেন করুণার বার্তা হয়ে আগমন করলেন। তিনি শুরুতেই মানুষের চিন্তার রূপান্তর ঘটালেন। মানুষকে পরিচয় করালেন একত্ববাদের সাথে, আল্লাহর ভয় ও বিচার দিবসের জবাবদিহিতার অনুভূতির মাধ্যমে অন্তরে জন্ম দিলেন নৈতিকতা ও মানবিকতার।

তিনি কেবল ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, ছিলেন এক দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, ন্যায়বিচারক ও সমাজসংস্কারক। মক্কায় দীর্ঘ তেরো বছরের দ্বীনি দাওয়াতে তিনি হৃদয় জয় করলেন। মদিনায় গঠন করলেন একটি বহুত্ববাদী সমাজ, যেখানে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক সবাই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতো। তিনি চুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করলেন, একটি আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য চাই সহনশীলতা, ইনসাফ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।

আদর্শ সমাজ গঠনে যে মৌলিক ভিত্তিটি নবীজী (সা.) স্থাপন করেছিলেন, তা হলো ন্যায়বিচার ও সামাজিক সাম্য। তিনি ঘোষিত করেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউই ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার ভাইয়ের জন্যও সে-ই কামনা করে যা সে নিজের জন্য কামনা করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

তিনি বলেননি যে, ধনী শ্রেষ্ঠ, তিনি বলেননি যে বংশ-মর্যাদা বা গাত্রবর্ণ কাউকে উত্তম করে তোলে বরং তিনি বলেন, আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদার অধিকারী, যে আল্লাহভীরুতায় উত্তম।

এই এক বাক্যই মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সাম্যবাদের মূলমন্ত্র। আজও যদি জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণের বিভাজন ভুলে মানুষ মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে, তবে তা নবীজির আদর্শেরই অনুসরণ হবে।

নারী মর্যাদা ও পারিবারিক মূল্যবোধ

নারীর প্রতি সমাজের অবহেলা দূর করে নবীজী (সা.) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নারীর মর্যাদা, সম্মান ও অধিকার। কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া যে সমাজে ছিল প্রথা, সেখানে তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি দুটি কন্যা সন্তানের প্রতিপালন করে যত্ন করে, সে আমার সঙ্গে জান্নাতে এমন করে থাকবে।” (বুখারি)

তিনি পারিবারিক জীবনকে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে ভালোবাসার ও সহযোগিতার মাধ্যমে সাজিয়ে তুলেছিলেন তিনি।

যুবসমাজ ও আদর্শ নেতৃত্ব

আদর্শ সমাজ নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি যুবসমাজ। নবীজী (সা.) ছিলেন এক অনন্য যুব-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নেতা। তিনি তরুণদের দায়িত্ব দিয়েছেন, প্রস্তুত করেছেন নেতৃত্বের জন্য। হযরত আলী, হযরত মুয়ায, হযরত উসামা ইবনে যায়েদসহ অনেক তরুণ সাহাবিদের তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন সমাজ পরিচালনার।

তাঁর দেখানো পথের অনুসরণে আজও যদি যুবসমাজ আত্মশুদ্ধি, জ্ঞানচর্চা, ইখলাস ও সেবাব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়, তবে সমাজকে কল্যাণের পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

নবীজির জীবন কেবল পঠনের জন্য নয়, তা অনুসরণের জন্য। আজকের সমাজে যখন মূল্যবোধ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, অসহিষ্ণুতা ও স্বার্থপরতা চারিদিকে, তখন আমাদের একমাত্র আশ্রয় হতে পারে তাঁর জীবনাদর্শ। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিটি স্তরে তাঁর আদর্শ প্রয়োগ করলেই গড়ে উঠবে শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ।

নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ছিল কুরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যা। তাঁর চরিত্র, আচরণ ও জীবনব্যবস্থা আমাদের সামনে যে সমাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা অনুসরণ করলেই পৃথিবী হতে পারে অনাচারমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও কল্যাণময়। আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের পথ নবীজির পদাঙ্ক অনুসরণেই নিহিত এ সত্য বুঝে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করাই আমাদের সবার দায়িত্ব।

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ