সোমবার, ০২ জুন ২০২৫ ।। ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ৬ জিলহজ ১৪৪৬

শিরোনাম :
মে মাসে এলো সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স গাজায় একদিনে প্রাণ গেল ৩৭ ফিলিস্তিনির, নিহত ৫৪ হাজার ছাড়াল প্রতিদিন কিশমিশ খেলে নারীদের যে উপকার বিশুদ্ধ কুরবানী পালনে সচেতনতা জরুরি : জাতীয় মুফতী বোর্ড ফাউন্ডেশনের সেমিনারে বক্তারা যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলি সমাবেশে সন্ত্রাসী হামলা, বেশ কয়েকজন আহত হজমের সমস্যা কমাতে উপকারী যেসব পানীয় অনুমতিহীন ২ লাখ ৭০ হাজার হজযাত্রী ঢুকতে পারলেন না মক্কায় প্রধান উপদেষ্টার সাথে সংলাপে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস চামড়া শিল্পের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করুন: ইসলামী ছাত্র আন্দোলন উপদেষ্টাদের প্রতি মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়ার আহ্বান

ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ‘বোবাকান্না’ শুনতে পাও হে কমিটি?


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বিশেষ প্রতিনিধি

তিনি একজন হাফেজ, মাওলানা ও মুফতি। জেলা শহরের একটি মসজিদের ইমাম ও খতিব। সঙ্গে মক্তবের ছাত্রদেরও পড়ান। বেতন পান ১২ হাজার টাকা। পরিবারে স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলে ঢাকার একটি মাদরাসায় পড়াশোনা করে। এক মেয়ে পড়ে স্থানীয় একটি মাদরাসায়। আর ছোট ছেলে এখনও কোলের শিশু। সব মিলিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের খরচ। সঙ্গে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা। গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা থাকেন অন্য ছেলেদের সঙ্গে। তাদেরও মাঝে মাঝে খরচ দিতে হয়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই ইমাম ও খতিব আক্ষেপ করে বলছিলেন, মসজিদ থেকে যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। বর্তমান বাজারে ১২ হাজার টাকা কিছুই না। ঘর ভাড়া ও বাজার খরচ চালাতেই সব টাকা খরচ হয়ে যায়। টিউশনি করে বাড়তি যে টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে কোনো রকম ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালান। মাস শেষে টানাটানি শুরু হয়। কখনো কখনো ধারকর্জ করে চলতে হয়। এভাবেই চলছে মাসের পর মাস। 

তিনি জানান, তিন বছর ধরে ইমামতি করছেন। এর মধ্যে দুই বারে বেতন বেড়েছে দুই হাজার টাকা। বেতনের কথা বললেই কমিটি বলে, শহরতলীর মসজিদ। আয় কম। তাছাড়া এলাকাবাসীও অবস্থাসম্পন্ন নয়। বেতন বাড়ানোর সুযোগ নেই। 
তিনি অনেকটা আক্ষেপের সুরে বলছিলেন, এই যে কোরবানি ঈদ এসেছে। কোরবানির কথা তো চিন্তাও করতে পারি না। ঈদে যে বোনাস দেওয়া হয় সেটার পরিমাণও খুবই কম। এটা দিয়ে ঈদে একটু কেনাকাটা করার সুযোগও হয় না। 

এই গল্পটি শুধু একজন ইমাম ও খতিবের নয়; লাখ লাখ মসজিদের ইমাম, খতিব ও মুয়াজ্জিনদের গল্প প্রায় একই। বর্তমান বাজারের চাহিদার তুলনায় বেতন-ভাতা পান এমন ইমাম-মুয়াজ্জিনের সংখ্যা হয়ত হাতেগোনা। লাখ লাখ মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন অস্বাভাবিক কম। সেটা দিয়ে বর্তমান বাজারের চাহিদা ন্যূনতমও পূরণ হয় না। কোনো রকম কষ্ট করে সংসার চালান তারা। বাহ্যিকভাবে তাদের দেখলে হয়ত কেউ পুরোপুরি বুঝতে পারেন না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই কষ্ট তাদের কুরে কুরে খায়। তাদের বোবাকান্না মসজিদ কমিটি কিংবা সমাজের মানুষ শুনতে পায় না। 

ইমাম-খতিবরা জাকাতের ওয়াজ করেন। কিন্তু খুব কম ইমাম-খতিবই জাকাত আদায়ের সুযোগ পান। কোবরানির ফজিলত নিয়ে মুসল্লিদের উদ্বুদ্ধ করেন তারা। কিন্তু বেশির ভাগ ইমাম-খতিব ও মুয়াজ্জিনের মনে চাইলেও কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না। ঈদের দিনও তাদের করুণার পাত্র হয়ে থাকতে হয়। তাকিয়ে থাকতে হয় মুসল্লিদের দিকে কিংবা মসজিদ কমিটির দিকে। এটা তাদের জন্য বড়ই গ্লানির বিষয়। এছাড়া পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা কিংবা প্রিয়জনদের সাধ-আহ্লাদ পূরণের সামর্থ্যও তাদের থাকে না। নিজে বা পরিবারের কেউ হঠাৎ জটিল রোগে আক্রান্ত হলে তাদের দুর্ভোগের আর শেষ থাকে না।  

দেশে জীবনমানের ব্যয় দিন দিন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া ছুটছে লাগামহীনভাবে। এর সঙ্গে মোটামুটি সামঞ্জস্য রেখে সরকারি চাকরিজীবীসহ বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ছে। গত এক দশকে অনেকের বেতন-ভাতা দ্বিগুণের কাছাকাছি চলে গেছে। অথচ এক্ষেত্রে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা অনেক পিছিয়ে আছেন। তাদের বেতন-ভাতা ধরাই হয় খুবই কম। বর্তমান বাজারের সঙ্গে এটার কোনো তুলনাই হয় না। যেখানে নাগরিক জীবনে ৪০/৫০ হাজার টাকা আয় করেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে ইমাম-খতিব ও মুয়াজ্জিনদের কাছে এই পরিমাণ বেতন স্বপ্নের মতো। রাজধানী বা শহরাঞ্চলের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা তুলনামূলক কিছুটা বেশি বেতন পেলেও মফস্বলের ইমামরা এক্ষেত্রে খুবই অবহেলিত। তাদের সব সময়ই জনসাধারণের হাদিয়া-তোহফা বা দানের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এটা তাদের জন্য আক্ষেপ ও হতাশার। 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন আশানুরূপ না বাড়ার পেছনে প্রধানত দায়ী মসজিদ কমিটি। দেশের সিংহভাগ মসজিদই কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়। সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কমিটির সদস্য হন। দায়িত্ব নেওয়ার পর মসজিদের বাহ্যিক রূপ বাড়ানো এবং অবকাঠামো নির্মাণের দিকে তাদের যতটা মনোযোগ থাকে ততটা থাকে না ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন বা সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দিকে। বেশির ভাগ কমিটিই এ ব্যাপারে তেমন একটা তোয়াক্কা করে না। উল্টো ইমাম-মুয়াজ্জিনকে কীভাবে পুরো সময় কাজে ব্যস্ত রাখা যায় সেই চেষ্টা করেন। কর্তব্যে সামান্য গাফিলতি হলেও কমিটি তা সহ্য করতে প্রস্তুত নয়। অন্য সব পেশার মানুষের সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটি নেই। অথচ কাঁটায় কাঁটায় দায়িত্ব পালনে সামান্য অবহেলা হলেও তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয় কমিটি। 

ভুক্তভোগীরা বলছেন, মসজিদ কমিটি আন্তরিক হলেই কেবল ইমাম-মুয়াজ্জিনরা দীর্ঘদিনের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। বর্তমান বাজারের সঙ্গে মোটামুটি সামঞ্জস্য রেখে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতি বছর বেতন-ভাতা বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় ইমাম সমাজের মহাসচিব মাওলানা মিনহাজ উদ্দীন আওয়ার ইসলামকে বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইমামরা অনেক পিছিয়ে আছেন। তাদের সামনে এগিয়ে নিতে হলে সর্বপ্রথম সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। ইমামদের বেতন-ভাতাটা যেন উপযুক্ত পরিমাণে হয়, সে বিষয়ে সরকারিভাবে নজর দেওয়া জরুরি।

এই ইমাম ও খতিব বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মসজিদগুলোর ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা কষ্টের সাথে দিনাতিপাত করছেন। তারা যেন তাদের পরিবার নিয়ে সম্মানের সঙ্গে এবং পর্দার সঙ্গে চলতে পারেন, সে ব্যবস্থা মুসল্লিদেরই করা উচিত। এখানে 'মুসল্লি' শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে—মসজিদ কমিটিও মুসল্লির অন্তর্ভুক্ত।

তিনি মনে করেন, ইমাম-মুয়াজ্জিনরা কীভাবে দিন যাপন করছেন, তাদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে কি না—এসব বিষয় নিয়ে মসজিদ কমিটিকে সজাগ থাকতে হবে এবং মুসল্লিরাও যেন সে খোঁজখবর রাখেন।

ঈদুল ফিতরের মতো ঈদুল আজহায়ও ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য একটি বোনাসের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন মাওলানা মিনহাজ উদ্দীন। তিনি বলেন, একইসঙ্গে এলাকাবাসী ও মুসল্লি-কমিটিকে আন্তরিক হতে হবে। ঈদের দিন ইমাম সাহেবের কেমন কাটছে, তিনি কীভাবে দিন পার করছেন, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে কি না—এসব বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত।

জাতীয় খতিব কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাওলানা শামীম মজুমদার আওয়ার ইসলামকে বলেন, ইমাম-খতিবরা সাধারণ মানুষের মাঝে তথ্য, ইসলামি দিকনির্দেশনা ও জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা উপস্থাপন করে যে ভূমিকা রাখেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বাস্তবতায় দেখা যায়—এই আলেমদের অনেকেরই কোরবানির সামর্থ্য নেই, অনেকে তো নেসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারীও নন, ফলে জাকাতও দিতে পারেন না।

বিশিষ্ট এই আলেম বলেন, এই বাস্তবতার আলোকে মাদরাসার শিক্ষা কারিকুলামকে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলা জরুরি, যাতে তারা অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের সক্ষম করে তুলতে পারেন। দেশের মাদরাসা বোর্ডগুলোকে এ বিষয়ে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা এখন সময়ের দাবি। একইসঙ্গে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনকেও এগিয়ে আসা উচিত।

মাওলানা শামীম মজুমদার বলেন, সরকারকেও প্রশিক্ষণ ও সহায়তার মাধ্যমে আলেমদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আলেমদের যে সামান্য বেতন দেওয়া হয়, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইমাম-খতিবরা চরম বৈষম্যের শিকার।

তিনি বলেন, বেদনাদায়ক হলেও সত্য, অনেক মসজিদের ফান্ডে কোটি কোটি টাকা থাকলেও ইমামদের প্রাপ্য সম্মানী সময়মতো দেওয়া হয় না। এটি নিঃসন্দেহে আলেম সমাজের প্রতি এক ধরনের জুলুম। ইমাম সাহেবের হাতেই কোরবানির পশু জবাই হয়, অথচ উৎসবের দিন তাঁর নিজের ভাগ্যে একটুকরো গোশতও জোটে না—এটা আমাদের জন্য গভীর লজ্জার বিষয়।

এসএকে/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ