ইনজামামুল হক
গাজায় চলমান ভয়াবহ মানবিক সংকট নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানকে উদ্দেশ করে এক আবেগময় খোলা চিঠি লিখেছেন বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ, লেখক ও স্কলার শায়েখ ড. আলী মুহাম্মদ আল-সাল্লাবি। এই চিঠিটি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ইসলামি সংবাদমাধ্যম মুসলিম মিরর -এ প্রকাশিত হয়। আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য চিঠিটির অনুবাদ তুলে ধরা হল-
সম্মানিত প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান– আল্লাহ আপনাকে হেফাজত করুন।
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আজ আমরা আপনাকে এমন এক বিশ্বাস ও মানবিকতার ভিত্তিতে সম্বোধন করছি যা অনেকের মধ্যেই বিলুপ্তপ্রায়। আপনি সেই নেতা যিনি অত্যাচারিতদের দুঃখ-দুর্দশাকে শুধু মানবিক দৃষ্টিতে নয়, বরং ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেন। আপনি জানেন, আল্লাহর বাণী কী:
“আর তারা, যাদের উপর জুলুম হয়, তারাই নিজেদের প্রতিরক্ষা করে।” (সূরা আশ-শুরা: ৩৯)
আমরা বহুবার দেখেছি আপনি নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যখন যুদ্ধের কারণে মানুষ তাঁবুতে আশ্রয় নেয়, আমরা আপনাকে তাঁদের পাশে পেয়েছি। আমরা দেখেছি, আপনি এতিম শিশুদেরকে ভালোবাসা ও নিরাপত্তার আশ্রয় দিয়েছেন।
আপনি বারবার সংকটাপন্ন মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। এ কারণেই বহু মানুষের হৃদয়ে আপনি আশার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। আপনি কখনো কারো সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করেননি, বরং নিজেই পৌঁছে গেছেন সাহায্য নিয়ে। আপনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তাঁদের কষ্ট লাঘব করতে। আপনি এমন এক নেতৃত্বের আদর্শ উপস্থাপন করেছেন যা অনুসরণযোগ্য। আপনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই বাণী বাস্তবায়ন করেছেন:
“এক মুমিন আরেক মুমিনের জন্য এমন একটি দালান, যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তি দেয়।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
আপনাকে আমরা বহুবার এতিমের চোখের জল মুছে দিতে দেখেছি, কতবার দেখেছি আপনি মায়ের কাঁধে হাত রেখে তাকে সাহস দিয়েছেন।
আপনি আশ্রয় দিয়েছেন সেইসব মানুষকে, যাদের জন্য দুনিয়ার সকল দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আপনার উপস্থিতি যেন তাঁদের জীবনে এক আশার আলোকবর্তিকা। আপনি তাঁদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন, আশার আলো আবার তাঁদের হৃদয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
এই সমস্ত কথা মাথায় রেখেই, আমরা এখন এমন এক জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আপনার কাছে আসছি, যারা সিরিয়া, আফগানিস্তান, সোমালিয়া প্রভৃতি দেশের জনগণের মতোই আপনাকে আশার আলো হিসেবে দেখে। যারা জানে, আপনার হৃদয়ে মানবিকতা ও ঈমান আজও জাগ্রত।
সম্মানিত প্রেসিডেন্ট!
আজ ‘ধৈর্যের নগরী’র মানুষ ভয়াবহ মানবিক সংকটের সম্মুখীন। ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ তাঁদের দুর্বল দেহকে গ্রাস করছে। শত্রু তাঁদের উপর বর্বর অবরোধ আরোপ করেছে। জীবনের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিশুরা রাত কাটাচ্ছে অনাহারে।
চরম আবহাওয়া ও রোগ-ব্যাধি তাঁদের জীবনে দুর্বিষহ যন্ত্রণা তৈরি করেছে। মায়েরা অসহায়ের মতো দেখছে শিশুদের আহারের কষ্ট, কিন্তু খাবার দিতে পারছে না। রোগীরা কাতরাচ্ছে, নেই ওষুধ বা সেবা। এটা শুধু ভূমি বা ঘরের যুদ্ধ নয়- এটা এক ভয়াবহ গণহত্যা, এটা এক মহা অপরাধ মানবতার বিরুদ্ধে, যা দিনের আলোয় ঘটে চলেছে। সারা পৃথিবী দেখছে, শুনছে- তবুও নীরব। এই নীরবতা বিবেকবান মানুষদের গভীরভাবে নাড়া দেয়।
প্রিয় প্রেসিডেন্ট!
আমরা সবাই দেখেছি, সম্প্রতি যখন দখলদার বাহিনী গাজায় একটি খ্রিস্টান উপাসনালয়ে হামলা চালায় এবং এতে তিনজন খ্রিস্টান নিহত হন-
বিশ্ব তখন জেগে উঠল। পশ্চিমা প্রতিনিধি দলগুলো দ্রুত পৌঁছাল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘটনাটিতে প্রতিক্রিয়া জানালেন।
সারা বিশ্ব থেকে প্রতিনিধি দল এসে শোক প্রকাশ করল। দখলদার রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু পর্যন্ত ক্ষমা চাইলেন। আমরা কোনো নিরপরাধ জীবনকে হালকা করে দেখতে চাই না- হোক সে মুসলিম বা খ্রিস্টান, সব জীবন পবিত্র।
কিন্তু আমাদের কষ্ট হয় এই প্রশ্নে: যখন হাজারে হাজারে মুসলমান শহীদ হন- ক্ষুধায়, অবরোধে, বোমায়- তখন কেন বিশ্ব তেমন করে প্রতিক্রিয়া জানায় না? মুসলমানের রক্ত কি কারো জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়?
‘ধৈর্যের নগরী’র মানুষ এখন আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁরা চান আপনি তাঁদের পক্ষে আওয়াজ তুলুন- এই অন্ধ-বধির বিশ্বের সামনে।
তাঁরা চান আপনি বিশ্বকে মনে করিয়ে দিন- তাঁরাও মানুষ, তাঁরাও বাঁচার অধিকার রাখে, তাঁরাও মর্যাদার যোগ্য।
সম্মানিত প্রেসিডেন্ট!
আমরা নিশ্চিত, এই হৃদয়বিদারক মানবিক সংকট আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমরা জানি, আপনার ঈমান ও মানবিকতা আপনাকে নিরব থাকতে দেবে না। তাঁরা বিশ্বাস করে- আল্লাহ আপনাকে যে জ্ঞান দিয়েছেন, আপনার আন্তর্জাতিক অবস্থান ও প্রভাব দিয়ে আপনি অনেক কিছু করতে পারেন।
আপনি তাঁদের রক্ষা করতে পারেন, তাঁদের কণ্ঠকে পৌঁছে দিতে পারেন বিশ্ব দরবারে, এই অবরোধ ভাঙতে উদ্যোগ নিতে পারেন। আপনাকে এসব অনুরোধ করা হয়েছে, কারণ আপনি সর্বদা সত্য ও মাজলুমদের পাশে ছিলেন।
সম্মানিত প্রেসিডেন্ট!
আমরা জানি, আপনি কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত দক্ষ ও প্রভাবশালী। আমরা চাই, তুরস্ক মানবতার জন্য একটি আশার বাতিঘর হয়ে থাকুক। এই কারণেই আমরা অনুরোধ করছি: আপনি ‘ধৈর্যের নগরী’র নীরব কণ্ঠস্বর হয়ে উঠুন। আপনি এমন উদ্যোগ নিন, যাতে এই ভয়াবহ অবরোধ শেষ হয়, মানবিক সহায়তা দ্রুত পৌঁছায়।
আমরা চাই, আপনি এমন প্রচেষ্টা চালান যাতে রাফা সীমান্ত স্থায়ীভাবে খুলে দেওয়া হয়- যাতে অনাহারে কাতর মানুষ ও অসুস্থদের জীবন বাঁচানো যায়।
সম্মানিত প্রেসিডেন্ট!
‘ধৈর্যের নগরী’র মানুষ আপনার উপর ভরসা করে। তারা চায় আপনি আবার তাদের পাশে দাঁড়ান- যেমন আপনি অতীতে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের এই অনুরোধ ঈমান, মানবতা ও স্নেহশীল ভাইয়ের দায়িত্ব থেকে উৎসারিত।
আল্লাহর কাছে আমরা দোয়া করি- তিনি যেন আপনার সব প্রচেষ্টায় বরকত দান করেন, আপনার প্রতিটি পদক্ষেপে আপনাকে পুরস্কৃত করেন, আপনাকে সম্মানিত ও সফল করেন এই দুনিয়া ও আখেরাতে।
লেখক: ড. আলী মুহাম্মদ আল-সাল্লাবি-
সেক্রেটারি জেনারেল, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্স