সোমবার, ০২ জুন ২০২৫ ।। ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ৬ জিলহজ ১৪৪৬


হজ: ভালোবাসায় বিলীন এক আত্মা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নাজমুল হাসান।

ভালোবাসা এক অপার রহস্য, আর আত্মসমর্পণ তার পরিণত রূপ। মানুষ যখন আল্লাহর প্রতি গভীরতম ভালোবাসাকে অন্তরে ধারণ করে আত্মনিবেদনের পথে যাত্রা করে, তখনই সে হজের সফরে রওনা দেয়। হজ কেবল একটি ইবাদত নয়; এটি এক প্রেমিক হৃদয়ের রবের দরবারে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মহোৎসব। এখানে দেহ, মন ও আত্মা—all in—একজন প্রিয়তমের প্রতি নিবেদিত হয়।

ইহরামের শুভ্রতা মানুষকে দুনিয়াবী পরিচয়ের আবরণ থেকে মুক্ত করে, পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের এক প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ তাআলা বলেন—
“যারা হজ করবে, তারা যেন ইহরামের অবস্থায় অশ্লীলতা, গুনাহ ও কলহ পরিহার করে...”
(সুরা আল-বাকারা: ১৯৭)

এই আয়াত হজের মহাকাব্যিক প্রেমে প্রবেশকারী আত্মার জন্য এক শুদ্ধতার আহ্বান। এই আহ্বান বাহ্যিক পোশাকের চেয়ে অনেক গভীরতর, অন্তরের পরিশুদ্ধতার এক অনুপম বার্তা।

এরপর যখন প্রেমে উদ্বেল আত্মা বাইতুল্লাহর তাওয়াফে লিপ্ত হয়, তখন সেই চক্কর কেবল শরীরের নয়; তা হৃদয়ের ঘূর্ণাবর্ত—প্রভুর ভালোবাসায় আত্মবিলয়ের এক নিঃশব্দ আর্তি। প্রতিটি চক্কর যেন আল্লাহর প্রতি আরও বেশি বিলীন হওয়ার প্রতিচ্ছবি।
বিখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বলেন,
"আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কাবা শরিফ তাওয়াফ করতে দেখেছি, আর তিনি বলছিলেন—‘হে কাবা! কতই না মহান তুমি! কিন্তু একজন মুমিনের সম্মান তোমার চেয়েও বড়।’” (তিরমিজি, হাদিস : ২০৩২)

হজের আরেক হৃদয়স্পর্শী অধ্যায় হলো সাফা-মারওয়ার সাঈ। সেখানে মাতৃত্ব, প্রেম, আস্থা আর ত্যাগের এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস লুকিয়ে আছে। হজরত হাজেরা (আ.)-এর সন্তানের জন্য পানির খোঁজে বারবার ছুটে চলার সেই অধ্যায় আজ প্রতিটি হজযাত্রীর জন্য এক প্রেমময় স্মারক। তার দৌড়ে ছিল না কোনো অভিযোগ—ছিল কেবল বিশ্বাস আর প্রভুর প্রতি আস্থা।
রাসুল (সা.) বলেন,
"হাজেরা (আ.) যখন ছুটে ছুটে পানি খুঁজছিলেন, তখন জিবরাইল (আ.) জমজমের স্থান নির্ধারণ করেন। আল্লাহ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দিয়েছেন।” (বুখারি, হাদিস : ৩৩৬৪)

সাঈ আমাদের শেখায়—আল্লাহর পথে ছুটে চললেই পথ তৈরি হয়।

এরপর আসে আরাফার ময়দান—এক কান্নাভেজা উপত্যকা, এক আত্মনিবেদনের শিখর। রাসুল (সা.) বলেন,
“হজ তো আরাফা।” (তিরমিজি, হাদিস : ৮৯১)
এই ময়দানে দাঁড়িয়ে বান্দা তার সমস্ত পাপ, দুঃখ ও আকুলতা নিয়ে প্রভুর সামনে নিজেকে উজাড় করে দেয়। হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) আরাফায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—
“হে আল্লাহ! আমার সব গোনাহ তুমি জানো, আমি জানি না তুমি আমাকে ক্ষমা করবে কি না। তবে আমি জানি, তুমি অতি ক্ষমাশীল। এই বিশ্বাসেই আমি এসেছি।”
(যদিও এটি প্রসিদ্ধ উক্তি, তবে কোনো নির্ভরযোগ্য হাদিস হিসেবে প্রমাণিত নয়)

আরাফা আমাদের শেখায়—প্রেমিক হৃদয় যখন আত্মসমর্পণ করে, তখন তা অনন্ত দয়ার দ্বারে পৌঁছে যায়।

হজের আরেকটি রূপ আত্মত্যাগের—যা কোরবানির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর মধ্যকার সেই ঐশী প্রেম, আত্মসমর্পণ ও প্রভুর আদেশে সম্মত হওয়ার কাহিনি আজো হৃদয় কাঁপায়। এটা কেবল পশু জবাই নয়—বরং আত্মার পশুত্ব, প্রবৃত্তির অহংকার ও নাফরমানিকে বিসর্জনের শপথ।

হজ আসলে আত্মার এক আলোকময় যাত্রা। এটি কেবল কিছু বিধান পালনের আনুষ্ঠানিকতা নয়—বরং এক গভীর প্রেম ও আত্মনিবেদনের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ। এক হজযাত্রী তার অস্তিত্ব দিয়ে যেন বলে ওঠে—
“নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু—all for Allah, the Lord of all the worlds।” (সুরা আন’আম: ১৬২)

হজ তাই এক প্রেমিক হৃদয়ের হিজরত—যে দুনিয়ার মোহ, ক্লান্তি, ও সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে তার প্রিয় প্রভুর নৈকট্য লাভের জন্য ছুটে যায়। হজ শেষে যে হৃদয় ফিরে আসে, তা আর আগের মতো থাকে না—সে হয়ে ওঠে নতুন, শুদ্ধ, আলোকিত।

আল্লাহ আমাদের সকলকে নববী আদর্শ অনুযায়ী হজ পালনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ