রবিবার, ০১ জুন ২০২৫ ।। ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ৫ জিলহজ ১৪৪৬


ইসলামি জীবনবোধ ও শিক্ষা বিস্তারে শহীদ জিয়া


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: সংগৃহীত

ড. মো. ময়নুল হক

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একজন ক্ষণজন্মা বীর পুরুষ। জীবনের প্রতিটি পরতে ছড়িয়ে আছে তাঁর বীরত্ব ও দুঃসাহসিকতার অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে তাঁর জীবনালেখ্য তাঁকে দিয়েছে অমরত্ব। এই মহান ব্যক্তিত্ব ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার নিভৃত পল্লী বাগমারা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মনসুরুর রহমানের কর্মস্থল কলকাতা ও করাচীতে তাঁর বেড়ে ওঠা, সেনাবাহিনীতে যোগদান, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন ও পুরুষ্কার লাভ, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান, জেড ফোর্স গঠন, যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বীর উত্তম খেতাব অর্জন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান, জননন্দিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ, রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন। রাজনীতির পিচ্ছিল পথপরিক্রমায় দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বে একজন সফল রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হওয়া এবং মুসলিম জাহানের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়াÑ এসবের প্রতিটি মঞ্চ যেন সৃষ্টিকর্তা তাঁর জন্য আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিলেন, তিনি শুধু আসন অলংকৃত করেছেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক যে দেশ ভূমানচিত্রে ঠাঁই পেল তার সূচনা লগ্নেই ইথারে ভেসে এলো একটি কণ্ঠস্বর: I major Zia I declare independent of Bangladesh. ২৭ মার্চ ভোর বেলা চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে এ ঘোষণা প্রচারিত হলো। ২৮ মার্চ একই কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো আরো একটি ঘোষণা: I Major Zia, on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, do hereby declare [the] independence of Bangladesh. সারাদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা-আবালবৃদ্ধ-বণিতা-সেনাসদস্যরা সবাই আশ্বস্ত হলো, ঝাঁপিয়ে পড়লো যুদ্ধে। ঘোষণা পত্রপাঠের আগে জিয়াউর রহমান যে কাজটি করেছিলেন তা ছিলো দুঃসাহসিক অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা। কর্নেল জানজুয়ার অর্ডার ফলো করতে বাধ্য হয়ে সোয়াত নামক অস্ত্র বোঝাই জাহাজই ছিলো তার গন্তব্য। ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় গণহত্যার ঘটনা ঘটায় স্বাভাবিকভাবেই চট্টগ্রাম ফুঁসে উঠেছিল ২৬ মার্চ। রাস্তায় রাস্তায় বেড়িকেট দিয়েছিল আমজনতা। সে সব বেরিকেট সরিয়ে সমুদ্র বন্দরে যাওয়াটা বিলম্বিত হচ্ছিল। পথিমধ্যে বন্দর ফেরত এক বাঙালি সিপাহী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে গাড়ি থামাতে বললে জিয়াউর রহমান গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির ড্রাইভার থেকে আড়াল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে? উত্তরে জানালো সে, আপনার আগে যে মেজর বন্দরে গিয়েছিলেন তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা শহীদ করে দিয়েছে। তৎক্ষণাৎ জিয়াউর রহমান গাড়িতে উঠে পড়লেন এবং ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন ব্যারাকে ফেরার। ব্যারাকে ফিরে সরাসরি জানজুয়ার বাসায় গিয়ে তার জামার কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে দোতলা থেকে নামিয়ে গাড়িতে তুলে রওয়ানা দিলেন রেল লাইনের দিকে, যেখানে বাঙালি অফিসাররা আরো কয়েকজন পাকিস্তানি অফিসারকে বন্দি করে রেখেছিলেন। জানজুয়াকে খাচায় ঢুকিয়ে দিলেন জিয়াউর রহমান। জানজুয়া সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের নামে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিল। স্রষ্ঠা যাকে বাঁচাবেন তাকে কেউ মারতে পারে না। গর্জে উঠলেন জিয়াউর রহমান ‘উই রিভোল্ট’। নিজের স্ত্রী ছেলে সন্তানের সাথে শেষ দেখাটাও করলেন না। উল্টো বলে উঠলেন তাঁকে এখন দেশের প্রয়োজন বেশি। বাঙালি অফিসার-জোয়ানদেরকে নিয়ে পাহাড়ের দিকে মুভ করলেন এবং রাতেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করলেন এবং সেখান থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা বারবার প্রচারিত হতে থাকলো।

যুদ্ধের পর জিয়া ফিরে গেলেন ব্যারাকে। না ফিরলেও হয়তো কোন বড় পদ পদবী পেয়ে যেতেন। আসলে তাঁর পেশাকেই তিনি বড় ভাবলেন। অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অল্প সময়ের ব্যবধানে জিয়াউর রহমান বিভিন্ন পদের দেয়াল টপকিয়ে মেজর জেনারেল পদে আসীন হলেন এবং হলেন সামরিক বাহিনীর উপ-প্রধান। ’৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে বরিত হলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর, পাল্টা ক্যু সংঘটিত হলে নিজ গৃহেই বন্দি হলেন জিয়াউর রহমান। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে উষার আলো দেখতে পেলেন ৭ নভেম্বর যখন সিপাহী-জনতা রাস্তায় নেমে এলো, বন্দি দশা থেকে মুক্তি পেলেন জিয়াউর রহমান। দ্বিতীয় দফা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলেন। ইতিহাসের এই মঞ্চে যেন সৃষ্টিকর্তা জোর করেই বসিয়ে দিলেন তাঁকে। সামরিক বাহিনীর প্রধান এক দূরদর্শী দেশপ্রেমিক এক ভয়াল অন্ধকার থেকে দেশকে উদ্ধার করলেন। প্রথমে হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে এবং তৎপরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। দেশ সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করলেন। অতিদ্রুত বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থায় ফিরে যেতে নিজে দল গঠন করলেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুযোগ তৈরি করে দিলেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উপর থেকে নিষোধাজ্ঞা তুলে নিলেন, তিনি সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষোধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নন্দিত নেতা হিসেবে বরিত হলেন।

একজন প্রাক্টিসিং মুসলিম ও আল্লাহতে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী বান্দাহ হিসেবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন জিয়া। যখন তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতেন ১৮ ঘণ্টা, সে সময়ও কোন ওয়াক্ত নামাজ পড়তে না পারলে সেটি কাজা আদায়ের চেষ্টা করে গেছেন। শহীদ জিয়া সংবিধানের শুরুতেই সংযোজন করলেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’। দেশের ৯২% মুসলমানের বোধ ও বিশ্বাসকে ধারণ করে সংবিধানের মৌল নীতিমালায় ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিস্থাপিত হলো এবং সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাসই হবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি সংবিধানে সংযোজিত হলো। সংবিধানের মৌল নীতিমালায় প্রতিস্থাপিত হলো সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে সামাজিক ন্যায় বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা। গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ বহাল থাকলেও জাতীয়তাবাদের ভিন্ন দর্শন দিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, সংস্কৃতি ও ভাষার চেয়ে ভূখণ্ডগত ঐক্য দেশ ও জাতীয় ঐক্যকে সুনিশ্চিত করবে। অন্য একটি দেশের লোকরাও বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং বাংলাদেশে অনেক উপজাতি গোষ্ঠী আছে, তারা বাংলা ভাষার বাইরে তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। জাতীয়তাবাদী এ দর্শন বাঙালি অবাঙালি সবাইকে একত্রিত করে ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠন, দেশের অর্থবহ উন্নয়নে সম্মিলিত প্রয়াস জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত হতে সাহায্য করে। জাতিকে বিভক্তির বিষবাষ্প থেকে মুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে তিনি মনোযোগী হলেন। কারণ, তিনি জানতেন জাতিকে বিভক্ত করে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। সাংবিধানিক এ পরিবর্তন সেরে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবার মনোযোগী হলেন দেশকে এগিয়ে নেয়ার উদ্বীপ্ত বাসনায়। মূল সূত্রতো রাসূল সা. এর সেই বাণী: তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও, সহযোগিতায় ও সহমর্মিতায় সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ হও।

একজন শাসকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো, দেশের নিরাপত্তা, দেশের জনগণের জীবনধারণের অত্যাবশ্যকীয় খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা করা এবং ইলম বা জ্ঞানার্জন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা সহজলভ্যকরণ। এ তিনটি দিকের বিবেচনায় যদি আমরা শহীদ জিয়ার স্বল্প সময়ের শাসনকালকে বিশ্লেষণ করি তাহলে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে শহীদ জিয়ার প্রথম কাজটিই ছিল দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং তা সফলভাবে করতে গিয়ে তাঁকে হতে হয়েছিল অত্যন্ত কঠোর। ক্যু আর পাল্টা ক্যুর ধারা বন্ধ করতে ও সামরিক বাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে তাঁকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। ব্যর্থতা যার মজ্জায় নেই সেই তিনি তার লক্ষ্য পানে অনবরত ছুটে চলেছেন শুধু সামরিক বাহিনীতেই নয় দেশটাকেই নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়ার জন্য। দেশটাকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বহিঃশত্রুর চোখ রাঙানি থেকেও মুক্ত করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত তিনি নজর দিয়েছিলেন দেশের জনতার খাদ্য ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থাপনায়। থাইল্যান্ড ও চীন থেকে উন্নততর প্রযুক্তি এনে কৃষিতে তিনি বিপ্লব ঘটান। এ ক্ষেত্রে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট তাঁর সহযোগী হয়েছিল। কাস্তে কোদাল কাঁধে নিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন, কৃষকদের সাথে ফসল কেটে, দিনমুজুরদের সাথে খাল কেটে তাদের সাথে খাবার খেয়ে মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেছেন জমি ফেলে না রেখে বছরে তিন ফসলী জমিতে রূপান্তরিত করতে, খাল খনন ও সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যম খাদ্যে স্বয়ংভরতা অর্জনের দীক্ষা দিয়েছিলেন জাতিকে তিনি এভাবেই।

তৃতীয়ত শহীদ জিয়া দেশের জনগণের শিক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে গণস্বাক্ষরতা অভিযান পরিচালনা করেন দেশব্যাপী। নারী-পুরুষ সবাইকে শিক্ষিত করে তোলার তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা, যা তাঁর হাতে বৈপ্লবিক সাফল্য এনে দিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীর হাত যেদিন কর্মের হাতে পরিণত হবে সেদিন এ দেশের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে (নারীকে) শিক্ষার আলো বঞ্চিত রেখে কোনো দেশের উন্নয়ন হতে পারে না। তাই শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষাকার্যক্রমে তিনি নিয়ে এসেছিলেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনই নৈতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ দক্ষ জনশক্তির যোগান দেবে, যা একটি দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সোপান রচনা করতে সক্ষম হবে। তিনি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত প্রায়শই উদ্ধৃত করতেন: ‘আল্লাহ ঐ জাতির ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটান না, যে জাতি নিজেরা নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্ত না ঘটায়।’

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শিক্ষাকার্যক্রমের এক অনবদ্য কীর্তি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। মাদরাসা ছাত্র ও ইসলামী জনতার দুইশত বছরের প্রাণের দাবি পূরণে এগিয়ে এলেন অকুতোভয় সৈনিক জিয়াউর রহমান। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এমন চিন্তার ঠাঁই যে তাঁর মাথায়ই ছিলো না, কেবলি নতুন সোপান তৈরি যার নেশা, তাকে রুখে কে? ১৯৭৬ সালের ১ ডিসেম্বর ঘোষণা দিলেন: সরকার অতিসত্বর এমন একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে, যা আধুনিক ও ইসলামী শিক্ষাকে সমন্বিত করে জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে সক্ষম হবে। এটিই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম সরকারি ঘোষণা। ঘোষণা দিয়েই থেমে থাকলেন না জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রফেসর এম. এ. বারীকে (সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান) সভাপতি করে সাত সদস্যের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি স্কিম কমিটি গঠন করলেন এবং সাত মাসের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করার নির্দেশনা দিলেন।

কমিটির টার্মস অব রেফারেন্সে বলা হলো:

ক. কলা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইসলামী শিক্ষার সমন্বয় কীভাবে করা যায়।
খ. নতুন আঙ্গিকে মাদরাসা শিক্ষা কীভাবে যুগোপযোগী করে এর উন্নতি সাধন করা যায়।
গ. ইসলামী শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়। এছাড়াও এই শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ণয়, শিক্ষার মাধ্যম, ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির প্রক্রিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারণ, আর্থিক খরচের পরিমাণ ইত্যাদি বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সরকারি এ উদ্যোগ নেয়ার পর ১৯৭৭ সালে মক্কায় প্রথম বিশ্ব মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন, ড. এম. এ. বারী, ড. এ. কে. এম. আইয়্যূব আলী, ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান এবং মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুর রহিম। উক্ত সম্মেলনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাবির প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান (ইবির সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর)। উক্ত সম্মেলনে মুসলিম দেশসমূহে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রূপরেখা প্রণীত হয়। এর দু’মাস পর ১৯৭৭ সালের ৩১ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল ওআইসির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের এ সম্মেলনে যোগদান করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ওআইসি ও বিভিন্ন মুসলিম দেশের অর্থানুকূল্যে এশিয়ার তিনটি মুসলিম দেশে (বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়া) তিনটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের পর ওআইসির এ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করে।

এদিকে প্রেসিডেন্ট জিয়া বারী কমিটির রিপোর্ট হাতে পেলেন ১৯৭৭ সালের ২০ অক্টোবর। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নেমে পড়লেন। ১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ঢাকায় প্রকল্প অফিস করে লন্ডন প্রবাসী ড. এ. এন. এম. মমতাজ উদ্দিনকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিলেন। স্থান নির্ধারণে প্রথমে গাজীপুরের সালনা, এরপর যশোর জেলার উপকণ্ঠে এবং সর্বশেষ শান্তিডাংগা-দুলালপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো এবং ১৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হলো। তারপর এসে গেলো সেই ঐতিহাসিক ক্ষণ, যার অপেক্ষায় ছিলেন এ জনপদের মুসলিম জনতা দু’শটি বছর! ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর তৎকালীন কুষ্টিয়া-যশোর জেলার সীমন্তবর্তী শান্তিডাংগা-দুলালপুরের মাটিতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি গড়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজ হাতে। তাঁর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো ভবিষ্যতের স্বপ্ন: I hope, this University will setup a bridge in the field of exchange thoughts among the intellectuals of the world.

জিয়াউর রহমানে সরকার জাতীয় সংসদে সর্বপ্রথম দ্য ইনিস্টিটিউট অব দ্য ইসলামিক এডুকেশন এ- রিচার্স অ্যাক্ট ১৯৮০ (৩১) পাশ করে। এই অ্যাক্টের ফলে বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণার পথ প্রশস্ত হয়। ঢাকা ধানমন্ডির ৬ নং রোডের ভাড়া বাড়িতে এটির কার্যক্রম শুরু হয় এবং এর ডিরেক্টর হিসেবে ড. এ. এন. এম. মমতাজ উদ্দিন চৌধুরীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। এ ইনিস্টিটিউটের উদ্যোগে হোটেল শেরাটনে ১৯৮১ সালে (৫ মার্চ-১১ মার্চ) সাতদিন ব্যাপী তৃতীয় আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার জন্য স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরে কারিকুল্যাম, পাঠ্যসূচি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তী সময়কালে দ্য ইনিস্টিটিউট অব দ্য ইসলামিক এডুকেশন এন্ড রিচার্স ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একীভূত করা হয় এবং এর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দকে আত্মীকরণ করা হয়।

এখন সগৌরবে দাঁড়িয়ে সেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, যা জাতির খেদমতে অনবদ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সুসমন্বিত উন্নয়নে শহীদ জিয়ার এই বাস্তব পদক্ষেপ আজ শুধু স্বর্ণালি ইতিহাস নয়-তাঁর প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর সহস্রাধিক উচ্চশিক্ষিত নৈতিক মান সম্পন্ন মানুষ উপহার দিচ্ছে, যারা দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের উচ্চতর জ্ঞান, মেধা, মনন, যোগ্যতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

লেখক: প্রফেসর, আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

এসএকে/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ