মুহাম্মাদ শোয়াইব
একটি সংঘাত, দুর্যোগ ও সংকটে পরিপূর্ণ বিশ্বে, মানবিক সহায়তা শুধু মানবিক কর্তব্য নয়, বরং এটি একটি নৈতিক অঙ্গীকার—যা মানবতার প্রতি এক ধরনের সংহতি ও সহযোগিতার বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধ, মহামারি ও জলবায়ু সংকটের মতো চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও মানবিক মূল্যবোধই পারে কার্যকর সমাধান এনে দিতে। এ ধরনের সহযোগিতা মানুষের মধ্যে সংহতির সংস্কৃতি গড়ে তোলে এবং দানের ও কল্যাণের চেতনা জাগ্রত করে। বিশেষত, যখন জীবনের নিরাপত্তা, জরুরি চিকিৎসা সেবা, খাদ্য ও আশ্রয় নিশ্চিত করার প্রশ্ন ওঠে, তখন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মূল্য অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না।
তবে মানবিক সহায়তার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থায়ন। মানবিক সংস্থাগুলো অনেক সময় সীমিত সম্পদ নিয়ে স্বল্পমেয়াদে সহায়তা প্রদান করে, দীর্ঘমেয়াদি পুনরুদ্ধার ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে পড়ে। যদিও মানবিক সহায়তা মূলত তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে কাজ করে, কিন্তু টেকসই শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য উন্নয়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গিও অপরিহার্য। এই উন্নয়নমুখী মানবিক সহায়তা সমাজকে সহিংসতা ও সংঘাতের চক্র থেকে বের করে স্থায়ী স্থিতিশীলতার পথে নিতে পারে।
ইসলাম সব সময় ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। অসহায় অসচ্ছল মানুষের সেবায় এগিয়ে আসা ইসলামে অন্যতম ইবাদত। আল্লাহ যাকে অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন তিনি সে সম্পদ থেকে অভাবী মানুষকে সাহায্য করলে তাতে আল্লাহতায়ালা খুশি হন।
এ ছাড়া বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। কেন না, কোনো মানুষ যখন কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়, সে তখন সবচেয়ে বেশি অসহায়ত্ব অনুভব করে। ওই সময় সে আন্তরিকভাবে অন্যের সাহায্য প্রত্যাশা করে।
আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে এরশাদ করেন, ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।’ (সূরা হুজরাত, আয়াত : ১০)
মহান আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন, ‘ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারী একে অপরের সহায়ক।’ (সূরা তওবা, আয়াত: ৭১)।
হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে।’ (বোখারি, হাদিস : ১৭৩২)।
মহানবী (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার ১০০ প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৬)।
নোমান (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘সব মুমিন দেহের মতো। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয়, তখন তার পুরো শরীরই তা অনুভব করে। যদি তার মাথাব্যথা হয়, তাতে তার পুরো শরীরই বিচলিত হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৬)
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও এরশাদ করেন, ‘মুমিনরা পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক দেহের মতো। দেহের কোনো অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে পুরো দেহ সে ব্যথা অনুভব করে।’ (বোখারি, হাদিস : ৬০১১)
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বান্দার সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ সে অপর ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৩১৪)।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তাদের (বিত্তশালী) ধনসম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা জারিয়াত, আয়াত : ১৯)।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এরশাদ করেন, ‘তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দরিদ্র, এতিম ও বন্দিদের খাদ্য দান করে।’ (সূরা দাহর, আয়াত : ৮)।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান অপর মুসলমানকে বস্ত্রহীনতায় বস্ত্র দিলে আল্লাহপাক তাকে জান্নাতের সবুজ বস্ত্র পরাবেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৩৫)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নাও, বস্ত্রহীন লোকদের বস্ত্র দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করে দাও।’ (বোখারি, হাদিস : ২৪১৭)।
রাসূল (সা.) বলেন, ‘হে বনি আদম! যদি উদ্বৃত্ত অর্থ দান কর, তাহলে ভালো হবে আর আটকে রাখলে ক্ষতি হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৯৬৪)।
রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘বান্দা ভাইকে সাহায্য করে, আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ২১৪৮)
মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে বস্ত্রহীন অবস্থায় বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে সবুজ বর্ণের পোশাক পরাবেন, খাদ্য দান করলে তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন, পানি পান করালে জান্নাতের শরবত পান করাবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৭৫২)
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় দফতর (OCHA)-এর ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১৯০ মিলিয়ন মানুষের সহায়তার জন্য ৪৭ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে। অথচ ২০২৬ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৩০৫ মিলিয়নে। এই চাহিদা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো সশস্ত্র সংঘাত এবং বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে। অথচ প্রাপ্ত অর্থায়ন এই বিশাল চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। ২০২৪ সালকে আধুনিক ইতিহাসে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য অন্যতম ভয়াবহ বছর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে; বছরের মাঝামাঝি সময়েই সংঘাত ও সহিংসতার কারণে প্রায় ১২৩ মিলিয়ন মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ছিল উদ্বেগজনকভাবে উপেক্ষিত।
জাতিসংঘ বারবার সতর্ক করে বলেছে, অর্থায়ন কমে যাওয়ায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, বিশেষ করে যুদ্ধে জর্জরিত অঞ্চলে ও যেখানে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। অথচ বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘ ৪৭ বিলিয়ন ডলার চাইলেও, বছরের শুরুতেই পেয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ অর্থায়ন—যা বৈশ্বিক সংহতির চিন্তা ও দুর্বলতম জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার নৈতিক চেতনার এক ধস নামার চিত্র তুলে ধরে।
এই প্রেক্ষাপটে, সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি অনুকরণীয় উদাহরণ স্থাপন করেছে। জাতিসংঘের আর্থিক ট্র্যাকিং সার্ভিস অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশটি ৭৮৮.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক সহায়তা দিয়েছে, যা বৈশ্বিকভাবে নবম বৃহত্তম দাতার অবস্থান নিশ্চিত করেছে। গাজা অঞ্চলে সংযুক্ত আরব আমিরাত দ্বিতীয় বৃহত্তম সহায়তাকারী। দেশটি ৩৯৬.৬ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে, যা মোট সহায়তার ১৪% এরও বেশি—এতে তারা যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গেছে। লেবাননে তারা ১২১.৮ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে, যা ১০.৭%—এতে তারা তৃতীয় বৃহত্তম দাতায় পরিণত হয়েছে। সুদানে সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে তারা ৬০০.৪ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে, এবং গত ১০ বছরে তাদের মোট মানবিক সহায়তা ৩.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
মানবিক সহায়তা মূলত মানুষের দুর্দশায় সাহায্য করার প্রচেষ্টা—প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ কিংবা অর্থনৈতিক সংকট হোক না কেন। এটি একটি সম্মিলিত মানবিক চেতনাকে প্রকাশ করে। এটি শুধু ত্রাণ বিতরণ নয়; বরং শান্তি নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর স্বনির্ভরতা অর্জনের পথ নির্মাণও বটে। এই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন, রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়িয়ে জরুরি ভিত্তিতে মানুষের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসা। বিশ্ব যখন মানবিক সংহতির বিষয়ে আরও সচেতন হচ্ছে, তখন আমরা একটি আরও মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের আশায় এগিয়ে যেতে পারি।
লেখক: মিডিয়া রিসার্চার, এমিরেটস সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ
এনএইচ/