|| শরীফ মুহাম্মদ ||
সৌদি বাদশাদের মধ্যে সম্ভবত সর্বশেষ বাদশা ছিলেন ফাহাদ ইবনে আব্দুল আজিজ (১৯২১- ২০০৫), মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংকটে কিছুটা নেতৃত্ব দিতেন সমন্বয়ের চেষ্টা করতেন। ৮০'র শেষ কয়েক বছর থেকে পুরো ৯০ এর দশকটি তার সক্রিয় সময়। ওই সময়ে আফগান প্রসঙ্গ, ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ, বার্মা রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ কিংবা রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর মত সংগঠনের সক্রিয়তা এসবে তার বড় ভূমিকা ছিল; সৌদি সরকারের আর্থিক ও অন্যান্য কিছু অবদান ছিল। বাদশা আব্দুল্লাহর যুগ থেকে যেটা কমতে শুরু করেছে এবং এমবিএস-এর বাবার যুগে এসে নাই হয়ে গেছে। যদিও ফাহাদের সময়ও তাকে নিয়ে সমালোচনা পর্যালোচনা অনেক ছিল।
বাদশা ফাহাদের সময় বিভিন্ন বিবদমান মুসলিম গ্রুপগুলোর সমঝোতা মিটিং হতো তায়েফে-জেদ্দায়। মুসলিম দেশগুলোর ওপর সৌদি সরকারের বড় একটি প্রভাব থাকতো। অনেকদিকে অনেক রকম টাকা পয়সা দিত, অনেককে নিজের দেশে আশ্রয় দিত। ৯/১১-পর এসবের অনেক কিছু বন্ধ হয়ে গেছে; প্রথমে চাপে, পরে খুশিতে।
আসলে মজলুম মুসলমানদের বড় কোনো সংকটে, বিশেষত আরব ভূখণ্ডের মজলুম মুসলমানদের কোনো অংশ, সে ক্ষেত্রে সৌদি আরব কিংবা আরব দেশগুলোর রাজা-বাদশাদের ভূমিকার কথা খুব বেশি করে মানুষ উচ্চারণ করে দুটি কারণে। একটি হচ্ছে ধনসম্পদে তাদের সমৃদ্ধি প্রাচুর্য, আরেকটি হচ্ছে পবিত্র ভূমি ও মুসলমানদের মনোযোগের কেন্দ্র তাদের ভূখন্ডে। মজলুম আরব নাগরিকদের ক্ষেত্রে রাজা বাদশাদের কথা বেশি আসে আরও একটি কারণে, সেটি হচ্ছে মজলুমরাও তো আরব। ফিলিস্তিন কিংবা গাজার ক্ষেত্রে সেটাই ঘটছে। আরব রাজা বাদশাদের প্রতি অপেক্ষা কৃত দুর্বল রাষ্ট্রের মুসলমানদের অনুযোগ অভিযোগ অভিমানের কিছু ব্যাপার এভাবেই ঘটে। যদিও দায়-দায়িত্বের দিক থেকে কারো দায় কম না।
হিংস্র-আইল বিষয়ে প্রথমদিকে নির্বিকারত্ব এবং পরবর্তীতে অশত্রু ও স্বাভাবিক হয়ে চলার মানসিকতা আরব রাজা-বাদশাদের প্রতি কোটি কোটি ভিনদেশী মুসলিমদেরকেও ক্ষুব্ধ করেছে। ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজ্জার সাথে যা হচ্ছে, এরপরও বাদশা সাহেবদের দলবদ্ধ নীরবতা, ঝুঁকি না নেওয়া, হিংস্র শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে চলার ব্যাপারগুলো দুর্বল মুসলমানরাও ভালো চোখে দেখছে না। এ যেন দুশমনের মাইরের কষ্ট দুঃখের সময়েও অন্যরকম বড় একটি দুঃখ এবং বঞ্চনা। ইরানের নানামুখি ভূমিকা কিংবা ঝুঁকি নেওয়ার পদক্ষেপগুলোর সময় এজন্যই আরব রাজা-বাদশাদের তুলনাটা সামনে চলে আসে। যুক্তি তর্ক অংক দিয়ে এইসব তুলনা, সমালোচনা বন্ধ করা যাবে না।
এর চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার হলো, হিংস্র-আইল এবং তার পৃষ্ঠপোষকেরা যদি আজকের ইরানকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করে ফেলতে পারে, তবে গ্যালারিতে বসে থাকা এইসব রাজা-বাদশাদের খারাপ দিন শুরু হবে। ইরান ছিল তাদের বাউন্ডারি ওয়ালের মতো। পশ্চিমা শয়তান ও আঞ্চলিক হিংস্র শক্তির বিরুদ্ধে প্রাথমিক ঠুসাটুসি ইরানের উপর দিয়ে যায় এবং যেত। ইরান শেষ হয়ে গেলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং চূড়ান্ত সব ধরনের ঠেলা ধাক্কার জেরটা যাবে তাদের উপর দিয়েই। সাদ্দাম গাদ্দাফির পর ইরান তুরস্ক পাকিস্তান এসব দেশের শক্তি নাই করে দিতে পারলে এইসব রাজা-বাদশাদের গলায় দড়ি ঝুলিয়ে ঘুরালেও এরা কিছু বলতে পারবে বলে মনে হয় না। সেই দিনটা যেমন তাদের জন্য দুঃখজনক, ঠিক তেমনি এখন যারা তাদের সমালোচনা করছে তাদের জন্যও অনেক মর্ম পীড়াদায়ক হবে। সেজন্য অস্তিত্বের প্রয়োজনে হলেও সকল কূটনৈতিক লিঁয়াজো ও সমঝোতার মধ্যেও কিছু বিষয়ে রাজা-বাদশাদের কিছু ফোঁসফাস থাকা দরকার, প্রতিবাদ ও অবস্থান থাকা দরকার। তা না হলে আজকের মজলুমরাই শেষ হবে না, আজকের রাজা-বাদশারাও আগামীকালের মজলুম হবে।
এমএইচ/