ওমর ইবনে আখতার রাষ্ট্র, সমাজনীতি, পারিপার্শ্বিকতা, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি বিষয় যেমন মানব জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তেমনি অর্থ ও অর্থ ব্যবস্থার অপরিহার্যতাও অনস্বীকার্য। আর একারণেই ইসলাম অর্থনীতির ক্ষেত্রে দিয়েছে সতর্ক ও মমত্বময় দৃষ্টি। রেখেছেন যাকাতের ন্যয় এমন এক ব্যবস্থা, যা পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু বিরলই নয় বলা চলে অদ্বিতীয়ও।
সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মোকাবিলায় যাকাত: যেখানে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মত কুফরি অর্থ ব্যবস্থাগুলো মানব সমাজের অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে, সেখানে ইসলাম জনগণকে দিয়েছে চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ নিখুঁত এক অর্থ ব্যবস্থা!
ইসলাম সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে এবং একনায়কতন্ত্রের কাছে জনগণের অর্থ জিম্মি থাকার মতো ভয়ংকর সমাজতন্ত্র থেকে মানুষকে মুক্ত করেছে। যাকাতের মাধ্যমে দূর হয়েছে জুলুম, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্য। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইনসাফ।
সম্পদের সুষম আবর্তন: এই মহান অর্থ ব্যবস্থার দাবি হচ্ছে, গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত না হয়ে সমাজে সুষম আবর্তন ঘটাতে হবে। কঠোর হুশিয়ারি আরোপ করা হয়েছে সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার বিরুদ্ধে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'আর যারা স্বর্ণ ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের কঠোর শাস্তির সংবাদ শুনিয়ে দিন। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা এর দ্বারা তাদের ললাট পার্শ্ব এবং পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। বলা হবে, এই তো__ যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন করো।' (সুরা তাওবা, আয়াত : ৩৪-৩৫)।
যাকাতের মুখ্য উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো, সম্পদ যেন সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিটি সদস্যের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, 'তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই যেন সম্পদ আবর্তন না করে।' (সূরা হাশর, আয়াত :৭)।
যাদের উপর যাকাত ফরজ: এজন্য ইসলাম নির্দেশ প্রদান করে, নিত্য দিনের প্রয়োজন পূরণ করার পর এবং নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাদ দিয়ে যদি কারো নিকট সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৫৯৫ গ্রাম) পরিমাণ রূপা কিংবা সাড়ে সাত তোলা (৮৫ গ্রাম) স্বর্ণ বা এর সমমূল্যের সম্পদ এক বৎসর সময় পর্যন্ত সঞ্চিত থাকে তাহলে সে ব্যক্তি সম্পদশালী। তাকে যাকাত প্রদান করতে হবে। ( হিদায়া ১ম খণ্ড)।
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন, 'তাদের সম্পদ থেকে যাকাত নিন যা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।' [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত:১০৩]।
যাকাত কি কেবল ঐচ্ছিক?: মানব সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোকে ঠিক রাখতে ইসলাম যাকাতের ব্যপারে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছে। যাকাত আদায়কে কেবল ঐচ্ছিক পর্যায়ে রাখা হয়নি। বরং সম্পদশালীর জন্য যাকাত আদায়কে করা হয়েছে বাধ্যতামূলক। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, 'তোমরা সালাত কায়েম করো, যাকাত আদায় করো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। আল্লাহ তো চান তোমাদের কলুষমুক্ত করে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করতে। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৩]।
যাকাতের সাথে নামাজের সম্পর্ক: একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়ার পর অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণের পর একজন ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ। এই নামাজ আর যাকাত কে কুরআনে একসাথে ৩০ বার উল্লেখ করা হয়েছে! আর এই দুটির উল্লেখ যেহেতু একসাথে, তাই যাকাত আদায় না করলে ব্যক্তির নামাজও কবুল হবে না।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, 'আমাদেরকে নামাজ কায়েম করার এবং যাকাত প্রদান করার হুকুম দেয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি (সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও) যাকাত আদায় করে না, তার নামাজও কবুল হয় না!' (তাবরানী কাবির থেকে সহীহ সনদে তারগীব কিতাবে ) এবং (ফাযায়েলে সাদাকাত, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৮) আরেক হাদিসে এসেছে, 'আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির নামাজ কবুল করেন না, যে যাকাত আদায় করে না। আল্লাহ তাআলা যখন নামাজ এবং যাকাতকে একত্রে বলেছেন তুমি তাকে পৃথক করো না।' (কানযুল উম্মাল)
যাকাত আদায় না করার শাস্তি: আর যাকাত ফরজ হওয়া সত্ত্বেও যারা যাকাত আদায় করে না তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুনিয়েছেন কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী। তিনি বলেছেন:'যারা যাকাত আদায় করে না, তারা শেষ বিচারের দিন দেখতে পাবে যে, তাদের সেই সব ধন-সম্পদ ভয়ঙ্কর সাপ হয়ে তাদের দেহ জড়িয়ে ধরছে। এসব বিষাক্ত সাপ তাদের দেহকে কঠিন ভাবে নিষ্পেষিত করবে, ছোবল দেবে এবং বলতে থাকবে-আমরাই তো তোমাদের আহরিত ধন-সম্পদ এবং আমরাই হলাম সেই সব রত্ন সম্ভার, যার প্রতি তোমরা এত আসক্ত ছিলে।'(সহীহ বুখারী)
যাকাত হিসেবে কাপড় দেয়ার ট্রেডিশন বদলাতে হবে: আমাদের সমাজে বর্তমানে যাকাত হিসেবে কাপড় দেওয়া হয়। এই কাপড় দেয়ার ট্রেডিশন কোথা থেকে এসেছে তা আমার জানা নেই। তবে নিয়ম হলো,যাকে দিবে তাকে টাকার মালিক বানিয়ে দিবে। একজনকে এপরিমান অর্থ প্রদান করবে যাতে সে কিছু করতে পারে। কমপক্ষে এতটুকু দেওয়া যেন ঐদিন তাকে কারো কাছে হাত পাততে না হয়। (হিদায়া ১ম খণ্ড)
আর যদি টাকা না দিয়ে রিকশা, সেলাই মেশিন অথবা একটি গাভী বা এজাতীয় কিছু ক্রয় করে দেয়, যা তার জীবিকা উপার্জনের একটি মাধ্যম হয়ে যাবে, তাহলে এটি আরও চমৎকার হবে। আর যাকাতের উদ্দেশ্যও পূর্ণ হবে পরিপূর্ণভাবে। কেননা যাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, সমাজ থেকে দরিদ্রতা দূর করা। মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা।
ইতিহাসের পাতায় যাকাত আদায়ের সুফল: আর সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা হয় কেবল যাকাতের মাধ্যমেই। এটা শুধু কথার ফুল ঝরানোই নয়, ইসলামের সোনালী যুগে বাস্তবেও তা প্রতিফলিত হয়েছিল। হতবল, দরিদ্র, শোষিত আরবরা মাত্র কয়েক বছরেই ইসলামী অর্থব্যবস্থার কল্যাণে এমন বদলে গিয়েছিল, সেখানে যাকাত নেওয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হতো। ইতিহাসও যুগ যুগ ধরে বহন করেছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কেননা ইতিহাসে যখনই কোন ইসলামী রাষ্ট্র পূর্ণরূপে যাকাত আদায় করেছে, সেখানেই দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়!
◾যরত উমর রাযি. এর খেলাফত কালের ঘটনা
জাবাল রাযি. ইয়েমেনের এক – তৃতীয়াংশ যাকাত কেন্দ্র পাঠিয়ে দিলেন। খলিফা উমর রাযি. বললেন, তোমাকে কি ট্যাক্স উসুল করতে পাঠিয়েছি? ধনীদের থেকে নিয়ে ওখানেই গরীবদের মাঝে দিয়ে দাও। গভর্নর জানালেন, যাকাত নেওয়ার মতো কেউ নেই। দ্বিতীয় বছর অর্ধেক যাকাত এবং পরের বছর পুরো যাকাত মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন।জানালেন, যাকাত নেবার মতো দরিদ্র লোক ইয়েমেনে নেই। (আল আমওয়াল, পৃষ্ঠা ৫৯৬)
যাকাতের সুফল ২য় উমরের খেলাফত কালেও: অনুরূপ ঘটেছে উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. এর খেলাফত কালেও। ইফ্রিকিয়া (বর্তমান তিউনিসিয়া) প্রদেশে তার নিযুক্ত যাকাত আদায়কারী ইয়াহিয়া বিন সাঈদ বলেন, আমি যাকাত কালেকশন করলাম কিন্তু দেবার মতো কাউকে পেলাম না। পরে ঐ টাকা দিয়ে স্থানীয় দাসদের কিনে ইসলাম গ্রহণের শর্তে আযাদ করে দিলাম। (ফিকহুয যাকাত, শায়খ ড.ইউসুফ আল-কারযাভী, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৬)
একটি আশ্চর্য জনক ঘটনা: অটোমান সম্রাজ্যের ৭ম খলিফা মুহাম্মদ আল ফাতিহ রহ. এর শাসনকালে। তার আমলে এক মুসলমান যাকাতের টাকা দেবার মতো কাউকে পেল না। অগত্যা থলেতে করে চৌরাস্তায় ঝুলিয়ে দিল। লিখে দিল – 'ভাই, আমি অনেক খুঁজেও কোন ফকির পাইনি। তুমি যদি অভাবী হও, নির্দ্বিধায় এটা গ্রহণ করতে পারো'। কথিত আছে যে, তিন মাস ঝুলে ছিল থলিটি।
আসুন, অর্থনীতিতে সমাজকে এগিয়ে নেই বহুদূরে:
মোটকথা, ইসলামী অর্থব্যবস্থা এমনই ভারসাম্যপূর্ণ যে, আমাদের বর্তমানে দরিদ্র-ক্লিষ্ট,শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে হলে এবং সত্যিকার অর্থেই দারিদ্র্য বিমোচন করতে হলে ইসলামী অর্থনীতি ছাড়া, যাকাতের সঠিক প্রয়োগ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিকরূপে যাকাত আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ - ঢাকা