আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ফোন এলেই বেজে ওঠে প্রস্তুতির ঘণ্টা। মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময়। দম ফেলার ফুরসত নেই, লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠতে হয়। সাইরেন বাজিয়ে গাড়ি ছোটে ঝড়ের বেগে। সবার মাথায় ভাবনা একটাই—কত দ্রুত আগুন নিভিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধার করা যায়।
অন্যান্য দিনের মতো শনিবার (৪ জুন) রাত ৯টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নে বিএম ডিপোতে আগুন নেভাতে গিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। আর সেখানে অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে ৯ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী নিহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন ৩ জন সার্ভিস কর্মী।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রায় ৩০ জন দগ্ধ ও জখম হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই ঘটনায় সর্বমোট ৪১ জন নিহত হয়েছেন এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। যার মধ্যে ২২ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ টেস্ট করছে সিআইডি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন একটি জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের সব কার্যক্রম জনগণের সেবায় নিবেদিত।
তৎকালীন বৃটিশ সরকার অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৯-৪০ অর্থ সালে ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টি করেন। তবে ১৯৮১ সালের ৯ এপ্রিল তৎকালীন ফায়ার সার্ভিস পরিদপ্তর ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুসারে একীভূত হয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীন রেসকিউ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে অর্ন্তভুক্ত হয়।
২০২২ সালের ৪ জুন সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৯ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী নিহত হয়েছেন। যা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৪১ বছর পর এই প্রথম একসঙ্গে এত ফায়ার সার্ভিস কর্মী নিহত হন। এর আগে, একসঙ্গে এত ফায়ার সার্ভিস কর্মী নিহত হননি।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক আনিসুর রহমান সাংবাদকদের বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা খুব কাছ থেকে পানি নিক্ষেপ করছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে কনটেইনার বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ অন্যরা দগ্ধ হন। কনটেইনার বিস্ফোরিত হওয়ার পর আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।’
সীতাকুণ্ড অগ্নিদুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের নিহত কর্মীদের নামের তালিকা:
১। মো. রানা মিয়া, ফায়ারফাইটার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-মানিকগঞ্জ (নিহত)।
২। মনিরুজ্জামান, নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-কুমিল্লা (নিহত)।
৩। আলাউদ্দিন, ফায়ারফাইটার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-নোয়াখালী (নিহত)।
৪। মো. সাকিল তরফদার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন (নিহত)।
৫। মিঠু দেওয়ান, লিডার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-রাঙ্গামাটি (নিহত)।
৬। রমজানুল ইসলাম, ফায়ারফাইটার, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-শেরপুর (নিহত)।
৭। নিপন চাকমা, লিডার, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-রাঙ্গামাটি (নিহত)।
৮। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ফায়ারফাইটার, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-ফেনী (নিহত)।
৯। মো. ইমরান হোসেন মজুমদার, লিডার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-চাঁদপুর (নিহত)।
নিখোঁজ ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের নামের তালিকা:
১। শফিউল ইসলাম, ফায়ারফাইটার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-সিরাজগঞ্জ (নিখোঁজ)।
২। ফরিদুজ্জামান, ফায়ারফাইটার, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-রংপুর (নিখোঁজ)।
৩। মো. রবিউল ইসলাম, ফায়ারফাইটার, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-নওগাঁ (নিখোঁজ)।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, সীতাকুণ্ডের ঘটনায় নজরুল ইসলাম মণ্ডলকে নিয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এখন পর্যন্ত ভর্তি দগ্ধ রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ জন। এর মধ্যে পোস্ট অপারেটিং ওয়ার্ডে (পিওডাব্লিউ) ছয় জন, জরুরি বিভাগে চার জন, আইসিইউতে দুই জন এবং এসডিইউতে ভর্তি আছেন দুই জন। এদের অর্ধেকের বেশির অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। এছাড়াও একজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ফায়ারম্যান গাউসুল আজমের বাবা আজগর আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘দূর থেকে একবার দেখেছি ছেলেকে। ছেলের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার খবরে পুরো পরিবার ভেঙে পড়েছে। সাতক্ষীরায় গ্রামের বাড়িতে জানানো হয়েছে, ছেলে ভালো আছে। গাউসুলের ৫ মাস বয়সী একটি সন্তান রয়েছে।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর তথ্যসূত্রে ১৯৮৯-২০২১ সাল পযর্ন্ত ১৭ জন নিহত হন।১৯৮৯-২০২১ সাল পযর্ন্ত নিহতদের তালিকা:
১। মো. মাহাবুবুর রহমান, ফায়ারম্যান, (৬/১/১৯৮৯ সালে নিহত), কর্মরত-বগুড়া ফায়ার স্টেশন।
২। মুসলিম উদ্দিন, ফায়ারম্যান, (২৬/১/১৯৯১ সালে নিহত), কর্মরত-নওগাঁ ফায়ার স্টেশন।
৩। মো. জহিরুল হামিদ, ফায়ারম্যান, (১২/১/২০০১ সালে নিহত), কর্মরত-সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন।
৪। মাহাবুব হোসেন খান, ফায়ারম্যান, (২৭/১২/২০০১ সালে নিহত), কর্মরত-বরিশাল ফায়ার স্টেশন।
৫। মো. আক্তার হোসেন, ফায়ারম্যান, (৩/১২/২০০৬ সালে নিহত), কর্মরত-নবাবগঞ্জ ফায়ার স্টেশন।
৬। মো. অমল চন্দ্র মন্ডল, ফায়ারম্যান, (১২/১/২০০৮ সালে নিহত), কর্মরত-পটুয়াখালী ফায়ার স্টেশন।
৭। আব্দুর রশিদ, লিডার, (১৬/২/২০০৮ সালে নিহত), কর্মরত-কুলাউড়া ফায়ার স্টেশন।
৮। আ. আজিজ হাওলাদার, ড্রাইবার, (১৬/২/২০০৮ সালে নিহত), কর্মরত-কুলাউড়া ফায়ার স্টেশন।
৯। নির্লেন্দু প্রসন্ন সিংহ, ফায়ারম্যান, (১৬/২/২০০৮ সালে নিহত), কর্মরত-কুলাউড়া ফায়ার স্টেশন।
১০। আবুল কালাম আজাদ, ফায়ারম্যান, (২১/২/২০০৮ সালে নিহত), কর্মরত-কুর্মিটোলো ফায়ার স্টেশন।
১১। মো. জালাল, ফায়ারম্যান, (৪/১০/২০০৯ সালে নিহত), কর্মরত-ছাগলনাইয়া ফায়ার স্টেশন।
১২। মো. শাহ আলম, ফায়ারম্যান, (২১/১০/২০১৫ সালে নিহত), কর্মরত-গোপালগঞ্জ ফায়ার স্টেশন।
১৩। মো. আবু সাঈদ, ফায়ারম্যান, (৩০/৬/২০১৬ সালে নিহত), কর্মরত-নরসিংদী ফায়ার স্টেশন।
১৪। মো. আব্দুল মতিন, ফায়ারম্যান, (১১/৫/২০১৭ সালে নিহত), কর্মরত- গোদাগাড়ী, ফায়ার স্টেশন।
১৫। মো. সোহেল রানা, ফায়ারম্যান, (৮/৪/২০১৯ সালে নিহত), কর্মরত-কুর্মিটোলো ফায়ার স্টেশন।
১৬। আব্দুল মতিন, ডুবুরি, (২৮/৮/২০২১ সালে নিহত), কর্মরত-বংপুর ফায়ার স্টেশন।
১৭। মো. মিলন মিয়া, ফায়ারফাইটার (২৬/১১/২০২১ সালে নিহত), কর্মরত (চট্টগ্রাম) ফায়ার স্টেশন।
স্থানীয় ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডটি সাধারণ অগ্নিকাণ্ড নয়। ভয়াবহ রূপ নেওয়ার কারণ হচ্ছে সেখানে অনেক ধরনের রাসায়নিক ছিল। সাধারণত এ ধরনের ডিপোতে ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনার থাকে। আমাদের তৈরি পোশাক, খাদ্য কিংবা ওষুধশিল্পের জন্য নানা ধরনের রাসায়নিক আনা হয়।
রপ্তানির জন্যও রাসায়নিক সেখানে রাখা হয়। এর মধ্যে বিষাক্ত, দাহ্য বা বিস্ফোরণ ঝুঁকিসম্পন্ন রাসায়নিক থাকে। সে জন্য নির্দিষ্ট কোন রাসায়নিক থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর বিস্ফোরণের ফলে সেটা একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু ও দগ্ধের ঘটনার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৮ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যুর এমন ঘটনা আগে কোনো দিন ঘটেনি। প্রায় ২৫ বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাজ করছি। এর আগে কখনো একটি ঘটনায় এত কর্মীর মৃত্যু হয়নি।’