বিশেষ প্রতিনিধি
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হলেও একটা সময় ‘ইলমের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত ছিল চট্টগ্রাম। সারাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ইলমের সন্ধানে ছুটে যেতো সেখানে। সত্যিকার অর্থেই ইলমের ‘জাহাজতুল্য’ ব্যক্তিত্বরা ছিলেন দেশের দক্ষিণের এই জনপদে। জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের আসনেও ছিলেন চট্টগ্রামের আলেমরা। সম্মিলিতভাবে যেকোনো কাজে অভিভাবকের আসনে থাকতেন সেখানকার আলেমরাই। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় চট্টগ্রাম সেই ঐতিহ্য অনেকাংশে হারাতে বসেছে। আগের সেই ইলমি অবস্থান ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে আলেম-উলামা অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি। আগের মতো সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আর চট্টগ্রামে হুমড়ি খেয়ে পড়ে না। যারা গোটা জাতির নেতৃত্ব দিতেন সেই আলেমের সংখ্যাও কমে আসায় নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি পুরোটা ধরে রাখতে পারেননি চট্টগ্রাম অঞ্চলের আলেমরা।
অপরদিকে দেশের রাজধানীর পাশাপাশি ঢাকা দিন দিন ইলমের রাজধানী হিসেবেও স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। আলেমদের নেতৃত্বের সিংহভাগ এখন ঢাকায়। আলেমদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন কিংবা সম্মিলিত প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব এখন রাজধানীতে অবস্থান করা আলেমদের হাতে। বড় বড় ইলমি মারকাজও গড়ে উঠেছে রাজধানীতে। এজন্য সারাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখন দলে দলে ছুটে আসছে ঢাকায়। মেধাবী শিক্ষার্থীদের সিংহভাগই এখন ঢাকার মাদরাসাগুলোতে পড়াশোনা করছে। ঢাকায় মাদরাসার সংখ্যাও বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। একটা সময় ঢাকাকে মসজিদের শহর বলা হলেও এখন ঢাকা মাদরাসারও শহর। এতে দিন দিন ঢাকা ইলমি অবস্থানের দিক থেকে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করছে।
কোনো অঞ্চল ‘ইলমের রাজধানী’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার নির্ধারিত কোনো মানদণ্ড নেই। এটা মূলত লোকমুখে চর্চা এবং জনসাধারণের প্রচলিত ধারণার ওপর নির্ভর করে। যখন চট্টগ্রামকে ইলমের রাজধানী বলা হতো তখনও কিন্তু এটা সর্বজন স্বীকৃত কিছু ছিল না। তবে ইলমি মানুষেরা বেশির ভাগই এটা বিশ্বাস করতেন। যারা এক সময় চট্টগ্রামকে ইলমের রাজধানী বলতেন তারাই এখন সেটার স্থানান্তর হয়েছে বলে মনে করেন। এটা শুধু ইলমি ক্ষেত্রে নয়, নানা ক্ষেত্রে হতে পারে। যেমন একটা সময় বাংলা সাহিত্যের রাজধানী মনে করা হতো কলকাতাকে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখন ঢাকা বাংলা সাহিত্যের রাজধানী। এটা খোদ কলকাতার লোকেরাও স্বীকার করেন। এর কারণ হলো, এক সময় কলকাতায় যারা বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্ব দিতেন, তাদের সিংহভাগ এখন আর নেই। ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে সেটা তারা পূরণ করতে পারেনি।
বাংলাদেশের ইলমি অবস্থানের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। এক সময় চট্টগ্রাম, সিলেট ও নোয়াখালী অঞ্চল ছিল ইলমের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। কালক্রমে তাতে ভাটা পড়ছে। যে অঞ্চল এক সময় পিছিয়ে ছিল তারা এগিয়ে যাচ্ছে। যারা এগিয়ে ছিল তারা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের একজন পরিচিত আলেম সেদিন অনেকটা আক্ষেপের সুরে বলছিলেন, একটা সময় আমাদের এলাকার আলেমদের দিকে গোটা দেশের মানুষ তাকিয়ে থাকতো। আর এখন আমরা তাকিয়ে থাকি ঢাকার দিকে। একটা সময় আমাদের এলাকার কেউ ঢাকায় পড়তে যেতো না। এখন বিপুলসংখ্যক ছাত্র পড়তে যাচ্ছে। ইলমি ব্যক্তিত্বরা দিন দিন আমাদের থেকে বিদায় হয়ে যাচ্ছেন। যারা আছেন তাদেরও আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করছি না। এখনও আমাদের অঞ্চলে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাওয়া ইলমের জাহাজতুল্য ব্যক্তিরা রয়েছেন। কিন্তু তাদের সেভাবে চিনে না জাতি।
ইলমি দিক থেকে ঢাকার এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একজন আলেমের বিশ্লেষণ হলো, ঢাকা যেহেতু দেশের রাজধানী এজন্য সবকিছুর সুবিধাই এখানে রয়েছে। এখানে উপায়-উপকরণ সহজলভ্য। তবে ঢাকার নিজস্বতা কম। এখানে দেশের নানা এলাকা থেকে আলেম-উলামা এসে স্থায়ীভাবে অবস্থান করেন। চট্টগ্রাম, সিলেট কিংবা নোয়াখালী অঞ্চলের ইলমি যে ব্যক্তিত্বটি এখানে এসে জায়গা করে নেন তিনিও ঢাকার পরিচয়েই পরিচিতি পান। এখানকার নাগরিক সুবিধার কারণে তারা নিজেদের ফুটিয়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ পান। মফস্বলের আলেমরা অনেক ক্ষেত্রে সেটা পান না। স্বাভাবিকভাবেই দিন দিন ঢাকায় স্থায়ী হওয়া আলেমের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ঢাকা এদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর দেশেরা রাজধানী হিসেবে ঢাকা এগিয়ে যাওয়া দেশের জন্যই ভালো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি দেশকে বিচার করে রাজধানী দিয়েই।
তবে অনেকের ভিন্নমতও আছে। কেউ কেউ মনে করেন, ইলম কেবল বাহ্যিক সুরতের নাম নয়। ভাষাগত দক্ষতার কারণে ঢাকা এগিয়ে গেলেও ইলমি গভীরতার দিক থেকে এখনো ঢাকা পিছিয়ে আছে। ইলমি গভীরতার জন্য জরুরি মানতেক-ফালসাফাসহ এমন অনেক শাস্ত্র আছে যেখানে ঢাকার আলেমরা পিছিয়ে।
তবে বিষয়টি বিতর্কের নয়, গভীর বাস্তবতার। সময়ের বিবর্তনে খরস্রোতা নদীও শুকিয়ে যায়। আবার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাও খরস্রোতা নদীর রূপ নিতে পারে। ইলমের চর্চা, বিকাশ এবং জনমনে এর প্রতিফলের বিষয়টিও তেমনি। একটা অঞ্চল সবসময় তার আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ইলমের চর্চায় ঘাটতি এলে কিংবা ইলমি ব্যক্তিত্বের সংকট দেখা দিলে সেই অঞ্চল তার স্বকীয়তা হারাবে এটাই স্বাভাবিক।
এমএইচ/