বিশেষ প্রতিনিধি
বহু বছর পর গতকাল (২৩ এপ্রিল) একটি চমৎকার দৃশ্য দেখল এদেশের ইসলামপ্রিয় মানুষেরা। দেওবন্দি ধারার প্রায় সব ইসলামি দলের শীর্ষ নেতারা এক টেবিলে বসলেন। নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা করলেন। দেশের চলমান সংস্কার, আগামী নির্বাচনসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে তাদের খোলামেলা আলোচনায়। পাঁচটি বিষয়ে তাঁরা ঐকমত্যও পোষণ করেছেন।
শেষ পর্যন্ত তাদের এই সম্প্রীতি কতদূর যাবে সেটা নিশ্চিতভাবে এখনই হয়ত কেউ বলতে পারবে না। তবে এই দৃশ্যটি যে অনেক বেশি আশা জাগানিয়া সেটা স্বীকার করবেন প্রায় সবাই। আর সেটাই দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।
গতকাল দিনভর ইসলামি দলগুলোর নেতাদের বৈঠকের ছবিই ভেসে বেড়িয়েছে ফেসবুকজুড়ে। অনেকে এই ছবি শেয়ার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। অনেকে জানিয়েছেন এটা তাদের কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে এমন ঐক্যই তারা প্রত্যাশা করেন।
গতকালের আয়োজনটি ছিল মূলত পীর সাহেব চরমোনাইয়ের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ডাকে নিজেদের মধ্যে সংলাপ। যে কয়টি দল একসঙ্গে বসেছিল নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে জনবল ও জনপ্রিয়তার দিক থেকে তারা সুস্পষ্ট এগিয়ে। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই তাদের দায়িত্বটুকুও বেশি। আর সেটাই পালন করেছে দলটি। সবাইকে ডেকে এক টেবিলে বসাতে পারাও কম সাফল্য নয়।
আমাদের দেশের রাজনীতির কালচার যেখানে পরস্পরের বিরুদ্ধে কাঁদা ছোড়াছুড়ি, সেখানে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সোহার্দ্য ও আলাপ-আলোচনাও অনেক বড় বিষয়। এমনকি ইসলামি দলগুলোর নেতাকর্মীরা যেভাবে ফেসবুকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন লেগে থাকেন, সেখানে একত্রে বসা, আগামী দিনের পথচলার পরিকল্পনা করা অনেক বড় ব্যাপার।
এদেশের রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোর নেতাদের একত্রে বসা, ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন, রাজনৈতিক জোট এই কালচারটা অনেক পুরনো। সেই আশির দশকে এক মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.কে কেন্দ্র করে পুরো ইসলামি অঙ্গন এক হয়ে গিয়েছিল। নব্বইয়ের দশকে নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সবার একসঙ্গে রাজপথে নামা, বেশ কয়েকটি দলের সমন্বয়ে ইসলামী ঐক্যজোট গঠন নিজেদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার অনেক বড় উদাহরণ। চলতি শতাব্দীর শুরুতে ২০০১ সালে ফতোয়াবিরোধী রায়কে কেন্দ্র করে সবাই একমঞ্চে সমবেত হওয়া কিংবা ২০১৩ সালে আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ.-এর ডাকে সবাই এককাতারে চলে আসার নজিরও আমাদের সামনেই রয়েছে।
গত প্রায় এক দশক ধরে ইসলামি দলগুলোর পারস্পরিক বোঝাপড়ায় বেশ ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর নতুন বাংলাদেশে ইসলামি দলগুলো আবার কাছাকাছি এসেছে। বেশ কয়েক মাস ধরে ইসলামি দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের মুখে বারবার আমরা ঐক্যের কথা শুনেছি। সবচেয়ে বড় ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামীসহ বৃহৎ ঐক্যচেষ্টাও চলছে।
আগামী নির্বাচনে ইসলামি সব দল মিলে একটি বাক্স দেওয়ার জোর আলোচনা চলছে। গতকালে বৈঠকটি সেই সম্ভাবনাকে আরও জোরালো করল। তবে ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের সম্ভাবনা যেমন আছে, সংকটের জায়গাটিও প্রকট। এসব দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্যকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা কম। পান থেকে চুন খসলেই তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন বলে বলে অভিযোগ রয়েছে। একই পথ, একই মতের হওয়া সত্ত্বেও তারা অন্যের ভালো অবস্থানটা সইতে পারেন না বলেও কারও কারও অভিযোগ। তাছাড়া আছে নানা মত, তরিকা ও মতাদর্শের বিষয়।এসব বিষয় পেছনে ফেলে দেশ ও ধর্মের স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে এদেশে ইসলামির শক্তি যে একটা ফ্যাক্টর এটা সবাই স্বীকার করেন।
আগামী নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত ইসলামি দলগুলোর ঐক্য অটুট থাকলে এবং সমঝোতার মাধ্যমে সবাই মিলে একত্রে নির্বাচন করতে পারলে সেই নির্বাচনটি ইতিহাস সৃষ্টি করবে। শুধু কয়েকটি সিট পাওয়াই প্রকৃত সফলতা নয়। এদেশের মানুষের কাছে একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারাই সবচেয়ে বড়। এদেশে মানুষ আলেম-উলামাকে পছন্দ করে, কিন্তু ভোটের বেলায় তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। এর বড় কারণ হলো, তারা মনে করে আলেমরা তো জিততে পারবেন না। ভোটটি নষ্ট করে লাভ কী! ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজেদের একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারলে তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
এনএইচ/