বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫ ।। ৩ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৬


দেওবন্দে ভর্তিযুদ্ধ: হাজারো আশার প্রতিচ্ছবি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

তাওহীদ আদনান ইয়াকুব

দারুল উলুম দেওবন্দ, উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও প্রভাবশালী ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইসলামি শিক্ষা, গবেষণা এবং সমাজে ইসলামের আদর্শ প্রচারে। দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা মূলত দীনি শিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্দেশে ১৮৬৬ সালে হয়েছে, যখন এখানে শিক্ষার উচ্চ মান বজায় রেখে হাজার হাজার আলেম প্রস্তুত করা হচ্ছিল। পৃথিবীজুড়ে এক শক্তিশালী ইসলামি চিন্তাধারা এবং আলেমদের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেওবন্দ থেকে।

দারুল উলুম দেওবন্দের ভর্তি পরীক্ষা: একটি ঐতিহ্য দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন প্রতি বছর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ভর্তি হতে আগ্রহী ছাত্রদের জন্য প্রাথমিকভাবে কঠোর পরীক্ষা প্রদান করা হয়, যা শুধু ছাত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতা নয়, বরং তার দীনি জ্ঞান, নৈতিকতা এবং আত্মবিশ্বাসও মূল্যায়ন করে। এই ভর্তি পরীক্ষা প্রতি বছর হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রের জন্য একটি মর্যাদার বিষয় হয়ে ওঠে।

এবার ২০২৫ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়েছে ৭ শাওয়াল থেকে, যা চলবে ১৮ শাওয়াল পর্যন্ত। এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছাত্রসংখ্যা বিপুল—প্রায় ৫০০০ ছাত্র দাওরায়ে হাদিসে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে, যেখান থেকে ৪০০ জন ছাত্র নির্বাচিত হবে। একইভাবে, মেশকাতে জামাতেও ভর্তি হওয়ার জন্য ৫০০০ ছাত্র অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যে থেকে ২০০ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হবে। এর বাইরে আরো বিভিন্ন জামাতে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। যেখান থেকে দুই পর্বে বাছাই শেষে সকল জামাতেই নির্দিষ্ট কোটায় ভর্তির সুযোগ পাবে চূড়ান্ত বাছাইয়ে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা।

ভর্তি পরীক্ষার ধাপসমূহ ভর্তি পরীক্ষা দুটি ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাছাইয়ের প্রথম ধাপে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত করা হবে দাওরায়ে হাদিসে ১০০০ ও মেশকাত শরিফে ৫০০ ছাত্রকে। প্রথম ধাপে মূলত ছাত্রদের মৌলিক জ্ঞান, কিতাব বোঝার ক্ষমতা, হিফজ এবং মুখস্থ শক্তি যাচাই করা হয়। ছাত্রের কিতাবি যোগ্যতা, তার চিন্তাভাবনা ও যুক্তিবোধ এবং আমল আখলাকের মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে তাকে পরবর্তী ধাপে উত্তীর্ণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

চূড়ান্ত বাছাই পরীক্ষা: প্রথম ধাপের পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়ে একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এখানে মৌখিক এবং লিখিত উভয় ধরনের পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই পরীক্ষায় ছাত্রের ভাষা দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং দীনি জ্ঞান গভীরভাবে যাচাই করা হয়। ১৮ শাওয়াল সকল পরীক্ষা সমাপ্ত হবে। এরপর ২১ শাওয়াল চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হবে। ফলাফল ঘোষণার পর উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মৌখিক (ভাইভা) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, যা ২৩ শাওয়ালের মধ্যেই সম্পন্ন করা হবে। ভর্তি কার্যক্রম ২৫ শাওয়ালের মধ্যে সম্পূর্ণ করতে হবে। এরপর ২৮ শাওয়াল পর্যন্ত সিট ও স্টুডেন্ট আইডি বণ্টন কার্যক্রম চলবে।

সবকিছু সম্পন্ন হওয়ার পর ১ জিলক্বদ থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে পাঠদান (দরস) শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। পরীক্ষার পরিবেশ ও মানদণ্ড দারুল উলুম দেওবন্দের ভর্তি পরীক্ষার একটি সাধারণ নিয়ম হলো- যে জামাতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক তার পূর্বের জামাতের সকল কিতাব আলাদা আলাদ ১০০ মার্কে পরীক্ষা হবে। এই ভর্তি পরীক্ষা কেবল একটি সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক প্রবেশিকা পরীক্ষা নয়, এটি একটি কঠিন মানসিক এবং জ্ঞানগত যোগ্যতারও মূল্যায়ন।

এর উদ্দেশ্য শুধু ছাত্রের একাডেমিক দক্ষতা নয়, বরং তার দীনি মূল্যবোধ, সততা, নৈতিকতা, এবং একনিষ্ঠতা যাচাই করা। দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হতে আগ্রহী ছাত্ররা যে পরিবেশে পরীক্ষা দেয়, তা অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণ। যেকোনো প্রকার পক্ষপাত বা বিশৃঙ্খলা এড়ানো হয়। ছাত্রদের সততা ও পরিশ্রমের মূল্যায়ন একেবারে নিরপেক্ষভাবে করা হয়। এই পরীক্ষার পরিবেশে ছাত্রদের মনোযোগের মাত্রা এবং দীনি শিক্ষার প্রতি তাদের ভালোবাসা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ফুল স্কলারশিপ এবং শিক্ষার সুযোগ যারা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হবে, তারা শুধু একটি শিক্ষাজীবন শুরু করবেন না, বরং তাদের জন্য থাকবে ফুল স্কলারশিপ এর সুবর্ণ সুযোগ। নির্বাচিত ছাত্ররা দারুল উলুম দেওবন্দে বিনামূল্যে পড়াশোনা করার সুযোগ পাবে। পাশাপাশি তাদের জন্য থাকবে মাসিক ও অন্যান্য আরো অতিরিক্ত বিভিন্ন মেয়াদি ভাতার সুব্যবস্থাও। এতে তাদের থাকার এবং খাওয়ার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানটি বহন করবে, যা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণায় আরও বেশি মনোযোগী হতে সাহায্য করে।

দারুল উলুম দেওবন্দের মূল্যবোধ এবং আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি দারুল উলুম দেওবন্দের ভর্তি পরীক্ষা যে সুনির্দিষ্ট এবং কঠোর মানদণ্ডের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তা প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যেরই অংশ। এখানে কোনো ধরনের সুপারিশ বা বাইরের প্রভাব কাজ করে না। শুধু ছাত্রের যোগ্যতা এবং দীনি মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে তা নির্বাচন করা হয়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এমন নীতির অনুসরণ করে আসছে, যা সমাজে ন্যায়ের এবং ইবাদতের সঠিক পথ অনুসরণের শিক্ষা প্রদান করে।

দারুল উলুম দেওবন্দের ভর্তি পরীক্ষা কেবল একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রবেশিকা পরীক্ষা নয়, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি, যা ছাত্রের দীনি জ্ঞান, চরিত্র এবং ভবিষ্যতের কাজের জন্য প্রস্তুতি যাচাই করে। যারা এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, তাদের জন্য এটি কেবল একটি নতুন শিক্ষাজীবনের সূচনা নয়, বরং একটি মহত্তর খেদমতের পথে প্রবেশের সুযোগও বটে। এই প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে একদিকে যেমন মেধা ও যোগ্যতা যাচাই করা হয়, তেমনি অন্যদিকে এটি দারুল উলুম দেওবন্দের একটি ঐতিহ্য, যার মাধ্যমে দীনি শিক্ষার সঠিক পথচলার দিশাও নির্দেশিত হয়।

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ