রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ।। ১৪ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২৯ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

আল্লামা আমিনুল হক রহ.: জীবনরেখা ও কর্মধারা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী

আল্লামা আমিনুল হক রহ.। আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক ছদরে মুহতামিম। একজন মুহাদ্দিস ও ইলমি মনীষী। আল্লামা ইউসূফ বিন্নুরী (রহ.) ও আল্লামা মুফতি আযীযুল হক (রহ.)-এর সোহবতপ্রাপ্ত। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহোদয়। ১৩৮৪ হিজরি থেকে প্রায় ছয় দশকেরও বেশি সময় জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় শিক্ষক, মুহাদ্দিস ও ছদরে মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। ইলমের প্রতিটি শাখায় তাঁর দীপ্ত পদচারণা ছিল। নাহু, সরফ, বালাগাত, মানতিক, তাফসির, ফিকহ ও হাদিসের দরস প্রদান করতেন।

শুনেছি, তিনি (২৬/০৪/২০২৫) শনিবারও হাদিসের দরস প্রদান করেছেন। আল্লামা আব্দুল মান্নান দানিশ (রহ.)-এর জানাজায় অংশগ্রহণের ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা বোধ করায় যাওয়া হয়নি। অসুস্থতা তীব্র অনুভব হলে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁর ইন্তেকালের বিষয়টি নিশ্চিত করেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

নিম্নে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনরেখা ও কর্মধারা আলোচনা করা হলো।

জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান :

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার আলমদার পাড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হযরত মাওলানা আমিনুল হক সাহেব রহ.। তাঁর পিতা হাজী নামুমিয়া ছিলেন এলাকার খ্যাতনামা জমিদার এবং এক প্রভাবশালী সমাজনেতা, যিনি সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।

শিক্ষা-দিক্ষা অর্জন :

তাঁর বিদ্যাজীবনের শুভসূচনা হয় মাওলানা আবদুল মালেক রাওজানী ও মাওলানা আবুল কাশেম (রহ.)—এই দুই গুণী সাধকের পরম সান্নিধ্যে। তাঁদের স্নেহময় তত্ত্বাবধানে তিনি কুরআন মাজীদের নাজেরা শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন দেশের প্রখ্যাত দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায়, জামাতে দাহুমে। আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে ও নিজের প্রতিভার আলোকে তিনি প্রতিটি জামাতে মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং ১৩৮২ হিজরিতে সম্মানজনকভাবে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। অতঃপর উচ্চতর জ্ঞানার্জনের অফুরন্ত সাধ তাঁকে নিয়ে যায় পাকিস্তানে। সেখানে তিনি হাদিসশাস্ত্রের বিশিষ্ট মনীষী আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি রহ. এর নিকট সাহিহ বুখারি এবং মুফতি ওয়ালি হাসান টুনকি রহ. এর নিকট তিরমিজি শরীফ অধ্যয়ন করেন। পাশাপাশি হাফেজুল হাদিস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরহস্তী রহ.-এর নিকট তিনি ‘তারজুমাতুল কুরআনের’ তাফসীর অধ্যায়ন করেন। জ্ঞানসাধনায় তাঁর এই নিরলস প্রচেষ্টা তাঁকে পরিণত করে এক উজ্জ্বল দীপ্তিতে, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অমলিন অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকে।

তাঁর অধ্যাপনা জীবন :

পাকিস্তানে উচ্চতর জ্ঞানার্জন শেষে, ১৩৮৪ হিজরিতে হযরত মাওলানা আমিনুল হক সাহেব (রহ.) জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় শিক্ষকতার গৌরবময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইলমের অঙ্গনে তাঁর পদচারণা ছিল সুবাতাসের মতো ব্যাপক ও দীপ্তিময়। নাহু, সরফ, বালাগাত, মানতিক, তাফসির, ফিকাহ—জ্ঞানসাগরের এইসব শাখায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষাদান করেছেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন আলোর দ্যুতি। তিনি জামিয়ার একজন বরেণ্য মুহাদ্দিস হিসেবে শানে গৌরবময় আসন অলংকৃত করেছেন, যাঁর হাতে গড়ে উঠছে জ্ঞান ও আমলের উজ্জ্বল প্রজন্ম। অতঃপর কিছুদিন তিনি জামিয়ার ছদরে মুহতামিমের দায়িত্বও পালন করেন। মৃত্যুপূর্ব তিনি জামিয়াতুন নূর আল-আলমিয়ার সদরে মুহতামিম ও সিনিয়র মুহাদ্দিসের দায়িত্ব পালন করেন।

আধ্যাত্মিক সাধনা:

ছাত্র যামানায় জামাতে উলা পড়াকালীন তিনি জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার তৎকালীন পরিচালক এবং আধ্যাত্মিক জগতের সুপ্রতিষ্ঠিত রাহবার হাজী ইউনুস সাহেব (রহ.) সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আল্লামা আবরারুল হক রহ.-এর হাতে বাইআত নবায়ন করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত মুফতি আবদুর রহমান রহ. এর কাছে বাইআত গ্রহণ করে ইজাযত ও খিলাফতের সৌভাগ্য অর্জন করেন।

মৃত্যু ও দাফন :

 শনিবার  (২৫/০৪/২৫) দুপুর ১০.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে জামিয়া পটিয়ার হাদিসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন এবং বেশ কয়েক বছর যাবৎ সদরে মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ইন্তেকালে আল-জামিয়া পটিয়ার সকল ছাত্র-শিক্ষক গভীরভাবে শোক প্রকাশ করেন এবং তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানায়। জামিয়া কর্তৃপক্ষ হযরতের পরিবারের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, জামিয়া পটিয়ায় তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হবে এবং মাকবারায়ে আযীযীতে তাঁকে দাফন করা হবে। সে হিসেবেই তাঁকে মাকবারায়ে আযীযীতে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। তাঁর জানাজায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। রব্বে কারীম, আমাদের শ্রদ্ধেয় ওস্তাদকে ক্ষমা করুন। তাঁর খেদমাত কবুল করুন। আখেরাতের সকল সঙ্কট আসান করুন। জান্নাতুল ফিরদাউসের উঁচ্চ মাকাম দান করুন, আমিন।

লেখক: উস্তাদ, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ