|| ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী ||
‘আল্লামা সুলতান যওক নদভী’— এ নামটিতে কী যেনো লুকিয়ে আছে। কোথাও দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কারো মুখে উচ্চারিত হলে কান উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। আমি ছোটবেলা থেকেই এ নামটির সাথে পরিচিত। উসতাযে মুহতারাম প্রিয় আদীব হুজুরের মুখে কতো শুনেছি এ নাম। শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় তিনি উচ্চারণ করতেন এ নাম আর আমাদেরকে বলতেন তাঁর কীর্তি ও অবদানের কথা। বলতে বলতে তিনি আপ্লুত হয়ে যেতেন আর আমরাও শুনতে শুনতে এক আলোর ভুবনে হারিয়ে যেতাম। আমার গর্ব, আমি আদীব হুজুরের ছাত্র হওয়ার সুবাদে শায়খের অনেক সান্নিধ্য পেয়েছি। দু‘আ পেয়েছি। স্নেহ লাভে ধন্য হয়েছি।
এ রমজানের পর প্রিয় ভাই বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মাওলানা হোসাইন মুহাম্মদ নাঈমুল হকের বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলাম দারুল মাআরিফে। শায়খের সাথে সাক্ষাতের কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পেলাম এবং এ সুযোগ কাজে লাগালাম। এ সাক্ষাতকে কেন্দ্র করেই ভাবছিলাম, আমি শায়খকে নিয়ে নিজের কিছু অনুভূতি লিখবো। শায়খ বেশ অসুস্থ। আল্লাহ্ তাঁকে শিফায়ে আজেলা দায়েমা নসিব করুন!
দুই.
‘আল্লামা সুলতান যওক নদভী’— এখন এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছেন। তাঁকে নতুন করে পরিচয় করানোর বা তুলে ধরার কোনো অবকাশ নেই। তাঁর সুপরিচিতি এবং সুখ্যাতি এখন বাংলাদেশ ও উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আরব জাহানেও ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর ছাত্র অসংখ্য অগণিত। দেশে এবং বিদেশে। আরবে এবং আজমে। তিনি ছাত্রজীবন কাটিয়েছেন ইলম আহরনের ফুলেল উদ্যানে শ্রেষ্ঠ মৌমাছি হয়ে। পরিশ্রম, সাধনা, ত্যাগ, অধ্যাবসায় ছিলো তাঁর ঈর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। আসাতিযায়ে কেরামের সান্নিধ্য ছিলো তাঁর জন্যে সব সময় শীতল, আরামদায়ক ও পাথেয়-জোগানো ছায়া। মা-বাবা’র স্নেহ-পরশ ছিলো যেনো আকাশের উদার ছায়া। প্রকৃতির অবারিত মায়া। পারিবারিক ঐতিহ্যে ইলম মিশে ছিলো বহু পুরুষ ধরে। কাবিরান আন্ কাবিরিন! তাঁর ইলম অর্জনের পথে বাধা হতে পারে নি কোনো বাধা। অভাব কিংবা অর্থকষ্ট। এমন কি শৈশবে স্নেহময়ী মায়ের চলে যাওয়াও শ্লথ করতে পারে নি তাঁর ইলমী সফরের গতি। সব অতিক্রম করে সাধনার সব পথ মাড়িয়ে কালের কোলে জায়গা করে নিয়েছেন আল্লামা সুলতান যওক নদভী আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে! তাঁর সান্নিধ্য পরশে সোনা হয়েছে অসংখ্য ছাত্র। তাঁর ইলমী গভীরতার বিশালতায় বসে কতোজন নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। দেখেছে— এক জায়গায় কেমন করে জমা হয়েছে অ-নে-ক জায়গার সুষমা। এক ব্যক্তির মাঝে কেমন করে সমবেত হয়েছে পুণ্যাত্মা পূর্বপুরুষের অনেক অনেক বৈশিষ্ট্য।
র্উদূ যেনো তাঁর মাতৃভাষা। কি গদ্য কি কাব্য। সবখানইে তিনি সমান সাবলীল। আরবী যেনো মিশে আছে তাঁর রক্তে মাংসে চিন্তায় চেতনায়। যা লিখতে চান তা-ই লিখে ফেলেন। যেভাবে লিখতে চান সেভাবেই লিখে ফেলেন। কখনো নসরে। কখনো নজমে। বলনেও এ-ভাষায় তিনি আরব- সাবলীল। শ্রোতা ভাবতে বাধ্য হয়— আরবী ভাষা এতো সুন্দর! এতো সহজ! তাহলে আমরা কেনো পারি না?
বাংলা ও ফারসীও তাঁর কলমে বাঙ্ময়। সাহিত্যের অমন সব সুন্দর ‘জীবাণু’তে তাঁর লেখা ও কথা ভরা থাকে, যা অজান্তেই পাঠককে বিমোহিত করে এবং শ্রোতাকে ফেলে দেয় আচ্ছন্নময়তায় .. মুগ্ধতায়। ধীরে ধীরে বলেন। ধীরে ধীরে লেখেন। কিন্তু অতল গভীরতায় তা শান্ত প্রশান্ত। তাঁর দরসে যারা বসেছেন তারা জানেন, মুক্তো ঝরে কেমন করে
তিন.
বেশ আগের কথা। আমি শায়েখের সান্নিধ্যে বসে ছিলাম তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান দারুল মা‘আরিফে তাঁর কামরায়। তখন আমাকে প্রায়ই যেতে হতো ওখানে মাসিক ‘আল-হক’ পত্রিকার কাজে। সিদ্ধান্ত হলো শায়খ আত্মজীবনী লিখবেন। ‘আল-হকে’ নিয়মিত তা প্রকাশ পাবে। আমার কাছে জানতে চাইলেন— কোন্ ভাষায় লিখবো? শায়খের হাসিময় মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি কী বলবো আমি জানি। তবুও অপেক্ষা করছলিাম শায়খ কী চাইছেন! আমি বললাম : আরবীতে! শায়খ বললেন : ‘আরবী র্উদূ আমার কাছে সমান।’ শেষ পর্যন্ত শায়খ উর্দূতেই শুরু করলেন। সম্ভবত এর কারণ ছিলো এই যে, তাঁর এ আত্মজীবনীমূলক লেখায় প্রচুর পরিমাণে উর্দূ কবিতা আসছিলো।
আল হামদুলিল্লাহ্। এ আত্মজীবনী’র প্রথম খন্ডের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ পেয়েছে। লেখা এখনো চলছে। আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে চলেছে ইলমে ওহী’র শ্রেষ্ঠতম এক বাহকের প্রতিভাঝরা সাধনামুখর জীবনের বর্ণিল ছবি। ঝরনাধারার মতো ছলছল শব্দপ্রবাহ পাঠকের মনে এঁকে দেয় মুগ্ধতার রাশি রাশি রেখা। জীবনের নানা দিক ও নানা অনুভবের এমন নিখুঁত বর্ণিল বর্ণনা চেতনায় জোয়ার বইয়ে দেয়। অবচেতন মনে পাঠক বলে ওঠে— ‘আমিও শরীক হতে চাই দ্যুতিময় সাফল্যের এই মিছিলে!’
পাঠকের কাছে আরো মনে হবে— শুধু জীবনী পড়ছেন না তিনি, বরং রূপ-রস-গন্ধ-ভরা এক বর্ণিল জীবন-কাহিনী’র সাথে সাথে তিনিও এগিয়ে চলেছেন শৈশব-কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে এক মহা সমাপ্তির দিকে, মুক্তো কুড়োতে কুড়োতে। গল্পের আচ্ছময়তা নিয়ে। অবিনাশী চেতনার কোনো ঊপন্যাসের অনিঃশেষ স্বাদ নিয়ে।
আল্লাহ্ এ আত্মজীবনীকে পূর্ণতা দান করুন! শায়েখের হায়াতকে আরো দারায করে দিন! (আহ, আজই তাঁর জানাযা হলো!!)
চার.
পটিয়ায় কেটেছে জীবনের অনেকটা সময়। প্রথমে ছাত্র হিসেবে। পরে উস্তায হিসেবে। মূলত সেখানেই মূর্ত হয়ে সবার সামনে তিনি ফুটে উঠছিলেন ক্রমে ক্রমে। বিকশিত হচ্ছিলো তাঁর প্রতিভা ও দূরদৃষ্টিময় শিক্ষাদর্শন ও চিন্তাধারা। কুরআনের ভাষা হিসাবে আরবীকে তিনি ব্যাপকভাবে ছাত্রদের মন-মানসে প্রোথিত করার কাজ শুরু করেছিলেন। আরবী ভাষার শিল্প-সুষমা ও নন্দনতত্ত্ব প্রায়োগিকভাবে উপস্থানের প্রয়াস পেয়েছিলেন।
এক সময় তাঁর প্রিয় শায়খ আবুল হাসান আলী আল-হাসানী নদভী রহ.-এর ইশারায় চট্টগ্রামের উপকণ্ঠে গড়ে তোলেন তিনি ‘জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া’। এ প্রতিষ্ঠান এখন ইলমে নববী’র এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ দরসগাহ্। দৃষ্টিনন্দন ভবন আর ক্রমবর্ধমান উন্নতি চোখ জুড়িয়ে দেয়। ছাত্র-উস্তাযের বিপুল সমারোহ বুঝতেই দেয় না— চট্টগ্রাম শহর এখান থেকে একটু দূরে। ক্বালাল্লাহ্ আর ক্বালার রাসূলের মধুর গুঞ্জনে আর্শ্চয এক জান্নাতি আবহ বিরাজমান এখানে। ইলমে ওহী’র নূর যেনো ঝরে-ঝরে পড়ে এখানে সকালে-সন্ধায়, রাতের নীরব প্রহরে।
এ প্রতিষ্ঠানের সবচে’ ঈর্ষণীয় মুহূর্ত হলো—
শায়খের দরস।
তাঁর ভাবগম্ভীর শান্ত সমাহিত জ্যোতির্ময় মজলিস।
তাঁর মুহাদারা।
তাঁর বুখারীর তাকরির।
অথবা মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে তাঁর ভাষণ।
এ প্রতিষ্ঠানকে এ পর্যন্ত নিয়ে আসতে তাঁকে কতো-যে চিন্তা ও পরিশ্রম করতে হয়েছে, তা জানে এখানকার প্রতিটি ভবনের ইট-পাথর। ধীরে ধীরে বেড়ে-ওঠা নারিকেল বীথি।
তবুও কী আর্শ্চয!
তাঁর মুখে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেইে!
সব সময় লেগে থাকে সারা মুখাবয়বে নববী হাসি।
আলো ছড়ানো।
দ্যুতি ছড়ানো।
নূর-ছাওয়া।
পাঁচ.
আমার যোগ্যতা নেই। আমার শব্দ নেই। কেমন করে তাঁকে আমি তুলে ধরবো? যে উচ্চতায় বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশ ও আরব জাহানে তিনি বসে আছেন, সে উচ্চতায় আমার দৃষ্টি পৌঁছবেই না। আমি শুধু তাঁর সান্নিধ্যে বসার কিছু টুকরো স্মৃতি বলতে বসেছি। এ বলার দায়টা যেনো আমারই। আমি যেনো বলতে চাই—
হে পৃথিবী,
আমাদের যওক সাহেবকে চেনো?
আমি চিনি! আমার মতো করে চিনি! তাঁর বরকতি মহান মোহন সান্নিধ্যে কেটেছে আমার কিছু সোনালি বেলা! এ নিয়েই আমি তৃপ্ত। আমি ধন্য। আহা, যদি পড়ে থাকতে পারতাম তাঁর নেক সুহবতে বেলার পর বেলা!
ছয়.
একটু পেছনে ফিরে যাই। আমি তখন ‘দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা’র ছাত্র। সে সময় হুজুর দু’বার সফর করেন নদওয়া। তাঁর সফরকে কেন্দ্র করে আমি ভীষণ আলোড়িতবোধ করছিলাম। দারুল মা‘আরিফ ও চট্টগ্রামের বন্ধুদের মাঝে একটা উৎসবমুখরতা লক্ষ করছিলাম।
এক সফরের আগে সিদ্ধান্ত হলো, এবার আমরা হুজুরকে সংবর্ধনা দেবো। মানপত্র দেবো। এ ধরনের সংবর্ধনা ও মানপত্র থেকে হুজুর অনেক ওপরে। তাঁর শান এবং মান হিসেবে আরো বড় পরিসরে, আরো অনেক বড় আয়োজনে তাঁকে মানপত্র দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা তো তাঁর ছাত্র। আমরা তাঁকে —পিতাকে নেক সন্তানের ভালোবাসার মতোই— ভালোবাসি। এখানে আয়োজন যতো ছোট্ট ও সীমিত পরিসরেই হোক, তার উৎস গুচ্ছ-গুচ্ছ নিখুঁত স্বচ্ছ অনাবিল শ্রদ্ধা ভক্তি ও ভালোবাসা। তাই আমরা মন খুলেই আয়োজন করলাম। সীমিত পরিসরেই। অবশ্য আমাদের সকল ক্ষুদ্রতা ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো যখন আমরা এ আয়োজনটা ঐতিহাসিক আল্লামা শিবলী মিলনায়তনে করতে পেরেছিলাম।
হুজুর নদওয়ায় পৌঁছার পরই আমরা তাঁকে আমাদের ছোট্ট আয়োজনের কথা জানালাম। তিনি ‘না’ করলেন না! মানপত্রটা প্রস্তুত করার দায়িত্ব চাপানো হয়েছিলো আমার কাঁধে। যে কাঁধ দুর্বল। যে কাঁধ যে-কোনো ভার বহনে অক্ষম। তবু লিখলাম কিশোর আবেগের ছায়ায়। পাঠ করলাম মুগ্ধতার রেশ গলায় করে। তারপর সমাই মিলে হুজুরের হাতে তুলে দিলাম। ঐ মুহূর্তটা সত্যিই আমাদের জন্যে ছিলো একটি দুর্লভ মুহূর্ত।
অনুষ্ঠানের পুরো সময়টাই ছিলো আবেগে ভাব-গাম্ভীর্যে পুষ্ট। শায়খ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এমনভাবে বসে ছিলেন, যেনো তিনি ‘আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সংস্থা’র কোনো গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারের সভাপতিত্ব করছেন! শুনছিলেন আমাদের ছোট ছোট অনুভূতি!
অনেক দিন পরে বাংলাদেশে এসে, দারুল মা‘আরিফে গিয়ে দেখেছি— সেই মানপত্রটি পরম যত্নে হুজুর রেখে দিয়েছেন নিজের কামরায়! অনেক বড় বড় মানপত্রের সাথে!
অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে আমি তা দেখলাম! অনেক স্মৃতি তখন ভেসে উঠছিলো চোখের সামনে।
বড়রা এমনই হন। ছোটদেরকে স্নেহসিক্ত করতে কখনো দ্বিধা করেন না। এ জন্যেই তাঁরা বড়।
সাত.
আমার ছোট্ট একটা প্রতিষ্ঠান ছিলো উত্তরায়। আল মা‘হাদ আল ইসলামী। বিমানবন্দরের কাছেই ছিলো অবস্থিতি। সেখানে হুজুর গিয়েছেন অনেকবার। হুজুরের ঢাকাকেন্দ্রিক অনেক পরামর্শসভা ও মিটিং এখানে হয়েছে। হুজুরের অবস্থানকালীন সময়টা আর্শ্চয এক ভালোলাগায় আমার কেটে যেতো। গর্বে মর্যাদাবোধে আপ্লুত হয়ে ভাবতাম— হুজুরের মেহমানদারিতে না জানি কী ত্রুটি হয়ে যাচ্ছে। তাঁর নূরানি চেহারায় তাকিয়ে তাকিয়ে মনে মনে বলতাম— ক্ষমা করুন হযরত!
একবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছি। হঠাৎ হুজুরের ফোন। বললেন : আমি বিমানবন্দরে। একটু আগে বাংলাদেশ নেমেছি। আসছি।
মুহূর্তেই চোখ থেকে উড়ে গেলো গাঢ় ঘুমের শেষচিহ্নটুকু। আলো জ্বেলে জ্বেলে গভীর রাতকে দিনময় করে তুললাম। হুজুরকে স্বাগত জানাতে নিচে এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
এইসব স্মৃতি এখন ভীষণ মনে পড়ছে। অথচ এ সব বলতে আমি এখন বসি নি। আমি শুধু চেয়েছিলাম এবারের সফরের তাজা স্মৃতিগুলো তুলে ধরতে।
কিন্তু প্রিয়জনের প্রসঙ্গ যে ভীষণ প্রিয় হয়!
কিছুই বাদ দিতে ইচ্ছে করে না! আল কালামু মা‘আল কিবারি ইয়াহলু ওয়া ইয়াহলু!
আবার ফিরে যাই চট্টগ্রামে।
আট.
প্রিয় ‘মিনহাজ ভাই এবং মাহমুদ মুজিব’ আমাদের অপেক্ষায় দারুল মা‘আরিফে। বারবার ফোন দিয়ে খবর নিচ্ছেন। আমরা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি পথে। তারা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন বিছানায়। ফজরের একটু পরে অনেক দিন পর পা রাখলাম দারুল মা‘আরিফে। কতো বদলে গেছে। নতুন নতুন ভবন নির্মিত হয়েছে। আলাদা লাইব্রেরি বিল্ডিং হয়েছে। অনেক জায়গা যোগ হয়েছে। এ যেনো বরকতের এক চিত্তাকর্ষক কাহিনী। একটু একটু করে জায়গা ও পরিধি বেড়েই চলেছে। যারা আগে জায়গা বিক্রি করতে গড়িমসি করছিলো তারাও আস্তে আস্তে হুজুরের হাতে জায়গা তুলে দিচ্ছে। আগের সেই নীরব ফাঁকা জায়গাটা এখন কী সুন্দর লোকালয়ে ও আবাদিতে ভরে যাচ্ছে।
বড়দের দূরদৃষ্টির ছায়া পড়ে এভাবেই আবাদ হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে কতো বিরান বিরান ভূমি।
আমার মনে পড়ে গেলো হযরত হাফেজ্জি হুজুর রহ.-এর মাদরাসায়ে নূরিয়া আশরাফাবাদ, ঢাকা কামরাঙিরচরের কথা।
নয়.
সফরের ক্লান্তি দূর করতে একটু ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু ঘুমটা আর একটু থাকলো না, দীর্ঘই হয়ে গেলো। তার জন্যে আফসোসও করতে হলো পরে অনেক। ঘুম থেকে উঠে শুনলাম, শায়খ অনেকক্ষণ যাবত আমাদের জন্যে অপক্ষো করেছেন। বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন আমাদের কথা। বড় অনুতাপ হলো ঘুমটার জন্যে। একটু কম ঘুমালে কী হতো!
আমরা যখন দেখা করতে হুজুরের বাসার দরোজায় দাঁড়াই, তখন দারুল মা‘আরিফের মিনারচূড়া থেকে ভেসে এলো আযানের ধ্বনি। আগেই জেনেছি, হুজুর ভীষণ অসুস্থ। অনেক দিন বাসার বাইরে যান না। সেই-যে ঈদের নামাজ পড়িয়েছিলেন আর বের হন নি। আজ বিবাহের অনুষ্ঠানে জোহরে উপস্থিত হবেন। তাই বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। আর ঠিক তখনই আমরা গেলাম! নাহ্! বড়ো অসময়ে এসে দাঁড়ালাম তাঁর দরোজায়। তবুও অসীম উদারতায় প্রস্তুতি গ্রহনের আগেই আমাদেরকে ডাকলেন। বসলাম। একটু পরই শায়খ এলেন। আল হামদুললিল্লাহ! হেঁটে হেঁটেই এলেন। এবং আমার কাছে মনে হচ্ছিলো ঠিক আগের মতোই এলেন! আমি মুসাফা করে হাতে চুমু খেলাম। হুজুর হাত বাড়ালেন মুআনাকার জন্যে। বড়ো তৃপ্তি ভরে কিছুক্ষণ শায়খের বুকে আচ্ছন্ন হয়ে থাকলাম।
নামাজের কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত কথা হলো। আমি শায়খের হালপুরসি করার এক সুযোগে বললাম : হুজুর! আপনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন! আপনাকে আমার কাছে আগের মতোই লাগছে!
জবাবে হুজুর মৃদু হাসলেন। তারপর একটু আবেগমিশ্রিত ভাঙা কণ্ঠে বললেন : মনে হয় আল্লাহ্ আমাকে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার ফায়সালা করেছেন!
আমাদের হযরত! অবশ্যই আল্লাহ্ আপনাকে আরো অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখবেন! আপনার মিশন ষোলকলায় পূর্ণ করবেন। আপনার গড়া এ উদ্যানে এসেছে যে-বসন্ত, তা আরো বিকশিত হয়ে ফুল ফোটাবে। সৌরভ ছড়াবে। আমোদিত হবে আশ-পাশ। কাছের পরিবেশ। দূরের পরিবেশ। সুদূরের বিরান পরিবেশ!
দশ.
পরের দিন বাসে উঠে যখন বীর চট্টলাকে বিদায় জানাই, তখন চোখ বার বার ভিজে উঠছিলো। হুজুরের ছবি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। বন্ধুবর মাওলানা আফিফ ফুরকানের নতুন বাসায় তাঁর হৃদয় উজাড় করা মেহমানদারির ছবিও দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো! তাঁর আন্তরিকতার এমন ব্যতিক্রমী আয়োজন কখনো ভুলবার নয়। প্রিয় ‘মিনহাজ-মাহমুদ’কে বললাম— নেমে পড়েন! বাস ছেড়ে দিয়েছে! তারা বললেন— আপনাদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না! আমি বারবার মুগ্ধ হওয়ার পর এখন আবার মুগ্ধ হলাম। প্রিয় জোবায়রও মুগ্ধ হলো। তাদের এ আন্তরিকতা ও আকাশ-উদারতার কথা মনে হয় কখনো ভুলতে পারবো না। জাযাকুমুল্লাহ।
এগারো.
সবশেষে যার কথা আলাদা করে না-বললে অকৃতজ্ঞতা হবে তিনি আমাদের কেন্দ্রবিন্দু নাঈম ভাই। প্রিয় নাঈম ভাই! আপনি ফোন না করলে এবার এ সময়ে আমাদের আসাই হতো না! আপনার জীবন প্রবাহের এ নতুন সফরের বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে খুব ভালো লেগেছে। মাদরাসার নুরানি পরিবেশে সুন্নাতে নববী’র পূর্ণ অনুসরণে এমন বরকতি বিবাহ মজলিস জীবনে কমই দেখেছি। আপনাদের দাম্পত্য জীবন সুখময় আল্লাহময় হোক!
হে দারুল মা‘আরিফ ও হাটহাজারি-পটিয়ার চট্টগ্রাম,
হে ইসলামের প্রাচীন দূর্গ,
বিদায়! আবার দেখা হবে!
তোমার বুকে আরো জন্ম হোক নতুন নতুন ‘যওক ছাহেব’!
প্রিয় বন্ধু,
এ লেখাটি হারিয়ে ভাবছিলাম— আহা, আজ যদি পেতাম! শায়খের বিদায়ের দিন একটু অশ্রু ঝরাতাম—স্মৃতির সাঁঝ-আকাশে ভেসে ভেসে! কাতার থেকে মিনহাজ ভাই বললেন যেনো, ভাববেন না! আমিও আপনার সাথে আজ কাঁদবো! পিতা হারানোর কান্না!
আহ! প্রিয় হযরত!
আপনার শূন্যস্থান কি বাংলাদেশে পূরণ হবে? ...
লেখক: আরবি ও বাংলা কথাশিল্পী, বহু গ্রন্থ প্রণেতা