মুহাম্মাদ শোয়াইব
গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে শুরু হওয়া হামাসের "তুফান আল-আকসা" অভিযানকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে হিজবুল্লাহ, আনসারুল্লাহ ও অন্যান্য ফিলিস্তিনপন্থী গোষ্ঠীর সামরিক তৎপরতা ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকায়, পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসরায়েল তাদের নজর ঘুরিয়ে নিয়েছে সরাসরি ইরানের দিকে।
যদিও ইরান দাবি করেছে যে, এই হামলাগুলো সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিচালিত হয়েছে, তবুও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সরাসরি তেহরানকে দায়ী করেছে। একই সঙ্গে ইরান তার মিত্রদের উপর প্রভাব খাটিয়ে যুদ্ধের বিস্তার ঠেকাতে চেয়েছে, যাতে ইরান নিজে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে না পড়ে। কিন্তু পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। একদিকে ইরানের রাজধানী তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার ওপর হামলা এবং ইরান ভূখণ্ডে সরাসরি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, অন্যদিকে ট্রাম্পের মতো আগ্রাসী মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফিরে আসা; এসব উপাদান ইঙ্গিত দিচ্ছে একটি সম্ভাব্য মার্কিন-ইসরায়েলি যৌথ হামলার দিকে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র B-2 Spirit বোমারু বিমান মোতায়েন করেছে ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া ঘাঁটিতে। ট্রাম্পের যুদ্ধংদেহী বক্তব্য এবং ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হুমকি, পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে তুলছে।
যদিও ওমানের মাধ্যমে কিছু কূটনৈতিক আলোচনা শুরু হয়েছে, তথাপি ট্রাম্পের বক্তব্য স্পষ্ট—"যদি প্রয়োজন হয়, আমরা সামরিক হস্তক্ষেপ করবো এবং নেতৃত্ব আমাদের হাতেই থাকবে।" এই প্রেক্ষাপটে দুটি প্রশ্ন সামনে এসেছে: "ইরানের বিরুদ্ধে কি সত্যিই সামরিক হামলা আসন্ন?" এবং "এই হুমকির মুখে ইরান কি তার সামরিক নীতিতে পরিবর্তন আনবে?" ইরানের সামরিক নীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে আত্মরক্ষা এবং আগ্রাসন প্রতিহত করা।
আয়াতুল্লাহ খোমেইনির পরিকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে ইরানের সামরিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে—যার কেন্দ্রে রয়েছে ‘ বড় শয়তান’ আমেরিকা ও ‘ছোট শয়তান’ ইসরায়েল বিরোধিতা। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক স্তরে শত্রু চিহ্নিত করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে।
এই নীতির আলোকে ‘প্রতিরোধ ফ্রন্ট’ বা ‘মুকাওয়ামা’ প্রকল্প গঠিত হয়েছে, যার মাধ্যমে ইরান নিজ সীমান্তের বাইরে যুদ্ধ প্রতিহত করতে চায়। অর্থাৎ, যুদ্ধকে নিজের মাটিতে না এনে বাইরের সহযোগী গোষ্ঠীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল ইরানের সামরিক কৌশলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তন এবং সরাসরি হামলার সম্ভাবনা ইরানকে হয়তো তার ঐতিহ্যবাহী প্রতিরক্ষা কৌশলে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করবে।
যুদ্ধ এখন আর শুধু সীমান্তের বাইরে আটকে নেই, বরং তা সরাসরি তেহরানের আঙিনায় পৌঁছে গেছে। তাই প্রশ্ন থেকে যায়—ইরান কি এখনো আত্মরক্ষার নীতিতে অনড় থাকবে, নাকি পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নতুন কৌশল গ্রহণ করবে? আর আন্তর্জাতিক সমাজ কি এ উত্তেজনার পথ পরিহার করে কূটনীতির টেবিলে সমাধানের পথ খুঁজে পাবে? ইতিহাসের পথচলা এখন সেই সিদ্ধান্তের দিকেই তাকিয়ে আছে।
এই প্রেক্ষাপটে, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাকের হাশদ আশ-শাবি, ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ এবং "ফাতেমিয়ুন" ও "জাইনাবিয়ুন" নামের যোদ্ধা গোষ্ঠীগুলো—যেগুলো ৮ ডিসেম্বর ২০২৪-এর আগ পর্যন্ত সিরিয়ায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে—তারা ইরানের প্রতিরক্ষামূলক সামরিক নীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালের ৩০ এপ্রিল ইরানের বিপ্লবী গার্ডের অধীনে একটি বিশেষ সামরিক ইউনিট গঠিত হয়, যেটি প্রথমে "রামাদান সদর দপ্তর" নামে পরিচিত ছিল, পরে এটি "কুদস বাহিনী" নামে পরিচিতি লাভ করে।
এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ইরানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—দেশের সীমানার বাইরে মিত্র মিলিশিয়া গঠন এবং গোপন ও প্রকাশ্য সামরিক ও গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে। তবে “তুফান আল-আকসা” অভিযানের পর এই প্রতিরোধ অক্ষের আওতাধীন গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ইঙ্গিত দেয় যে, ইরানের বহির্বিশ্বভিত্তিক প্রতিরক্ষা বলয় মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর ফলে ইরানের সামরিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হুমকির মুখে পড়েছে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং ট্রাম্পের আবারও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া—এই দুটি ঘটনা ইরানের সামরিক নীতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন না আনলেও, দেশটির সামরিক হুমকি সম্পর্কে উপলব্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। ইসরায়েলের সরাসরি হামলা এবং ট্রাম্পের ঐতিহ্যগত সামরিক হস্তক্ষেপ বেছে নেওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ইরান সরকারকে দেশীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক সামরিক মহড়া পরিচালনার দিকে ধাবিত করে।
প্রথম মহড়ায় মূলত নতাঞ্জ, হেন্দাব ও ফোরদু পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে বিমান হামলা থেকে রক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়, এবং এর পাশাপাশি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও, এই মহড়াগুলোর সাথে সাইবার নিরাপত্তা, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ, বিশেষ বাহিনী এবং সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান সংক্রান্ত মহড়াও একযোগে পরিচালিত হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে ইরান তার আকাশ প্রতিরক্ষা, সাইবার নিরাপত্তা, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ এবং স্থল ও আকাশ বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সম্ভাব্য আকাশ হামলার মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে—বিশেষ করে পারমাণবিক স্থাপনা, জ্বালানি অবকাঠামো ও সামরিক ঘাঁটিগুলো রক্ষায়।
এছাড়াও, ইরানের কারমানশাহ অঞ্চলে অনুষ্ঠিত বিশেষ বাহিনী ও সন্ত্রাসবিরোধী মহড়ায় ভূমি থেকে পরিচালিত যুদ্ধবিমান, কমান্ডো ইউনিট এবং আকাশ অবতরণকারী বাহিনীর অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই মহড়ায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবিলার কৌশলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। মহড়ার সময়, জাগরোস সমুদ্র নৌঘাঁটির অংশ হিসেবে ইরানের নৌবাহিনীতে একটি গোয়েন্দা জাহাজ যুক্ত হয় এবং বিপুল গোপনীয়তার মধ্যে থাকা আন্ডারগ্রাউন্ড নৌ-মিসাইল ঘাঁটিগুলোও প্রদর্শিত হয়। পাশাপাশ
এনএইচ/