বুধবার, ২১ মে ২০২৫ ।। ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ২৩ জিলকদ ১৪৪৬


তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আল্লামা মুহাম্মাদ আশরাফ আলী (রহ.)

হযরত মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.) (মৃত্যু-৩১ জুলাই ২০০৮খ্রিস্টাব্দ) এর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় কিশোরগঞ্জে। সম্ভবত ১৯৬০/৬২ সালে। ফারেগ হওয়ার পর আমার কর্মজীবনের সূচনা হয়েছিল জামিয়া ইমদাদিয়াতে। তাঁর পিতা হযরত মাওলানা আহমাদ আলী খান (রহ.) ছিলেন জামিয়া ইমদাদিয়ার প্রথম আজীবন মুহতামিম। মাওলানা আতহার আলী (রহ.) এর নির্দেশে আমার প্রথম বছরে দাওরায়ে হাদিসের কিতাব পড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। নির্দিষ্ট উস্তাদ ছুটিতে থাকায় একদিন আমি দাওরার ঘন্টায় গিয়েছিলাম। ওই দিন বাকা’ইদা বা সবক ছিল না। সেদিন মরহুম খান সাহেবদের জামাতকে তিরমিজি শরীফের একটি সবক পড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। সে সুবাদে তিনি আমাকে তাঁর ছাত্র বলে পরিচয় দিতেন। তবে আমি তাঁকে বন্ধু হিসাবেই দেখতাম। তাঁর পুত্র মাওলানা উবায়দুর রহমান খান এবং ড. ওয়ালীয়ুর রহমান খানকে আমি ভাতিজা বলে ডাকি। আমি তাঁকে সম্মান করতাম মাওলানা আহমদ আলী খান (রহ.) এর সাহেবজাদা হিসেবে। ইলমী যোগ্যতার কারণে তাঁকে মহব্বত করতাম। তিনিও আমাকে মহব্বত করতেন এবং মনের কথা বলতেন। শায়খুল ইসলাম মাওলানা আতহার আলী (রহ.) এর হুকুমে আমি সে মাদরাসায় গিয়েছিলাম। মাওলানা খান সাহেব ছিলেন হযরতের রাজনৈতিক শিষ্য। কিশোরগঞ্জ থেকে চলে আসার পরও তাঁরা আমাকে বিভিন্ন উপলক্ষে দাওয়াত দিয়ে নিতেন। বাসা থেকে খানা পাঠাতেন। আমাদের মাঝে খুবই আন্তরিক মহব্বত ছিল।

তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ধৈর্য্যশক্তি ছিল অনন্য। বিভিন্ন জটিল কাজকর্মে আমরা এর প্রকাশ দেখেছি। তিনি যখন বেফাকের মহাসচিব ছিলেন, তখন কোনো কারণে তাঁর ওপর খুব চাপ ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি কোনো মানসিক পেরেশানীতে ভুগছেন? তিনি বললেন, তেমন কিছু নয়। অথচ জাতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেফাকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তাঁর মাথায় তখন বড় চাপ ছিল। এতে বুঝলাম যে, প্রতিকূল অবস্থায় তিনি কখনো পেরেশান হতেন না। বিভিন্ন সময় লক্ষ্য করেছি, তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।

বাগ্নীতা ও বক্তৃতায় তিনি ছিলেন সমকালীন যুগে দেশের মধ্যে বিখ্যাত। গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে প্রজ্ঞাপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ওয়াযের জন্য তিনি মশহুর ছিলেন। যখন তিনি বক্তব্য দিতেন, খুব ধীরস্থির ভঙ্গিতে অত্যন্ত সুচিন্তিত ও দর্শনপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন। যেখানে জোর দেওয়ার প্রয়োজন সেখানে এত দ্রুত আওয়াজের উচ্চতা বাড়াতেন যে শ্রোতাদের রক্ত গরম হয়ে যেত। জনতার মধ্যে না‘রা লেগে যেত।

তাঁকে যখনই স্মরণ করি, তাঁর সাথে করা সফর, মাহফিল ও ইলমী কাজকর্মের কথাই আগে মনে পড়ে। সর্বপ্রথম আমি এই কথাটি শুনেছি তাঁর একটি বয়ানে, তিনি খুব সুন্দর করে এক দমে বলে যাচ্ছিলেন—‘একজন মুসলমান প্রথমে মুসলমান, তারপর দার্শনিক; একজন মুসলমান প্রথমে মুসলমান, তারপর বৈজ্ঞানিক; একজন মুসলমান প্রথমে মুসলমান, তারপর ইঞ্জিনিয়ার; একজন মুসলমান প্রথমে মুসলমান, তারপর ডাক্তার; একজন মুসলমান প্রথমে মুসলমান, তারপর প্রশাসক; একজন মুসলমান প্রথমে মুসলমান, তারপর রাজনীতিক; একজন মুসলমান প্রথমে মুসলমান, তারপর ব্যবসায়ী; একজন মুসলমান প্রথমে মুসলমান, তারপর কৃষক বা শ্রমিক। অর্থাৎ একজন মুসলমান যাই করুক না কেন, তার প্রথম পরিচয় সে মুসলমান। এই অনুভূতির নাম ঈমান।’

মাওলানা খান সাহেব (রহ.) খুবই দূরদর্শী এবং উন্নত চিন্তার অধিকারী ছিলেন। সাধারণ আলেমরা যেসব বিষয় জানতো না বা ভাবতে পারতো না, তিনি সেসব বলতেন। জাতির জরুরি বিষয় হলে আলেমদেরকে সাবধান এবং সর্বসাধারণকে সতর্ক করতেন।

মাসিক মুনাদী, মাসিক নিয়ামত, মাসিক মদীনা, তানযীম বার্তা, আত তাওহীদ, ভাসানীর ‘হককথা’, দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইনকিলাব ইত্যাদি পত্রিকায় গভীর তাৎপর্যপূর্ণ নিবন্ধ ও প্রতিবেদন লিখতেন। লেখা, অনুবাদ করা ও সম্পাদনার হাত শক্তিশালী ছিল।

সবচেয়ে বড় কথা, নীতি ও আদর্শের ব্যাপারে তিনি কখনো ছাড় দিতেন না। দেশ-জাতি ও মুসলমানদের স্বার্থে অনেক কাজ করতেন, কিন্তু কখনো কোনো কিছুর বিনিময়ে নীতি-নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হননি।

বেফাকের প্রায় সূচনা লগ্নে শায়খুল হাদীস আজিজুল হক (রহ.) সাহেবের পরেই তিনি মহাসচিব নির্বাচিত হন। তখন গরিবী অবস্থায় তিনি বেফাককে প্রতিষ্ঠিত এবং আলেম সমাজের কাছে পরিচিত করেছিলেন। কখনো কখনো নিজের অর্থ ব্যয় করে সভা-মিটিংও করতেন। তাঁর আমলেই বেফাকের বড় সম্মেলনটি বারিধারায় আমেরিকান অ্যাম্বাসির সামনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নিশর্ত ও সম্মানজনক স্বীকৃতির কথা তিনি বলেছিলেন।

পটিয়ার মুহতামিম মাওলানা হাজি মুহাম্মদ ইউনুস সাহেব তখন বেফাকের সভাপতি ছিলেন। তবে সরকারসমূহের আচরণ প্রকাশ পাওয়ার পর ২০০৩ সালে তিনি স্বীকৃতির বেড়াজালে না গিয়ে আলেমদেরকে কওমী মাদরাসায় পড়ে, প্রয়োজনে আলিয়া এবং সাধারণ শিক্ষা থেকে ব্যক্তিগতভাবে সনদ নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এর প্রচার দৈনিক ইনকিলাব, মাসিক পাথেয়সহ কয়েকটি পত্রিকায় হয়েছিল।

জামিয়া এমদাদিয়া থেকে চলে আসার পর বার্ষিক মাহফিল ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক যেতাম। কোনো বছর খতমে বুখারীতেও দেখা হতো আমাদের। আদব ও বিনয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল তাঁর সহজ সরল অভিব্যক্তি ও আচরণে। এমন মানুষ কমই আছেন আমাদের সমাজে—ব্যক্তিত্ববান, ভারী অথচ বিনয়ী।

তাঁর শেষ জীবন বোধ হয় কেটেছে ঢাকা ও কিশোরগঞ্জ মিলিয়ে। পাঁচ-ছয় বছর ফরিদাবাদ মাদরাসায় এবং ৩ বছর মিরপুর দারুল উলুম-৬ এর এহতেমামের দায়িত্বে ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতা ছিল, কিন্তু ধৈর্য্যশক্তি ছিল সীমাহীন। ঢাকা আসলে দেখা হতো। মাঝে মধ্যে কোনো মাহফিলে দেখা হলে ব্যতিক্রমধর্মী কথা-বার্তা বলতেন। হাস্যরসের মাঝেও ইলমী ধারা প্রকাশ পেত।

সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক (রহ.) এর জামিয়া রাহমানিয়ার একটি অনুষ্ঠানে। তিনি খেলাফত মজলিসের অভিভাবক পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। বেফাকের সহ-সভাপতি ছিলেন। মরব্বী হিসেবে বিভিন্ন মাদরাসায় দ্বীনিয়ায় যেতেন। জামিয়ার মেহমানখানায় একান্ত আলাপচারিতায় একবার আমাকে বললেন, ‘হুজুর! এখলাস কি দুনিয়া থেকে উঠে গেছে? দেশে-বিদেশে যত জায়গায় যাই বা মনোযোগ দিই, হতাশাব্যাঞ্জক আলামত পাই।’ আমি বললাম, ‘আমিও তো আমাদের মধ্যেও এখলাস খুঁজি, খুব একটা পাই না।’—এই ছিল আমার ও তাঁর মধ্যে শেষ কথা। এর কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন শুনি, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। গভীর বেদনা ও শূন্যতা অনুভব করি। মহান আল্লাহ তাঁকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দান করুন। যখনই তাঁর কথা মনে পড়ে, এই দোয়া করি।

তাঁর সন্তানরা আমার অত্যন্ত স্নেহের। তাদের উদ্দেশ্যে এবং তাঁর ছাত্র ও ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলি,
খান সাহেব (র.) অযথা সময় নষ্ট করতেন না। পড়া, কিতাব মুতালাআ করা, তসবীহ পাঠ করা,
দরূদ শরীফ পড়া না হয় দেশ-জাতির জন্য চিন্তায় মশগুল থাকতেন তিনি। বেহুদা গল্প-গুজব করা, বিত্তবান বা প্রভাবশালী মানুষদের পিছনে সময় দেয়া কিংবা ঘর-সংসারের কাজে ব্যস্ত
হয়ে দিন রাত কাটিয়ে দেয়ার মত স্বভাব তাঁর কখনোই ছিলনা। তাঁর সন্তান ও ছাত্রদের উচিত তাঁর এ আদর্শ পরিপালন করা। আমি তো ১৮/১৯ বছর বয়স থেকে তাঁকে চিনি। হযরত মওলানার জিন্দেগীর আলোকে বলতে গেলে আমি মনে করি, বর্তমান সময়ে আলেম সমাজের করণীয় হলো দূরদর্শিতার সাথে হিকমতপূর্ণ পদ্ধতিতে ইলমী ও দাওয়াতি মারকাযগুলিকে ধরে রাখা আর আল্লাহ পাকের দরবারে রাত জেগে কান্নাকাটি করা। তিনিও সব সময় বলতেন, আলেম সমাজ নবীজি (সা.) এর ওয়ারিস হিসাবে নেক কাজের আদেশ এবং অন্যায় - অসৎ কাজে নিষেধ করা এবং বাতিলের বিরুদ্ধে হকের আওয়াজ বুলন্দ করার কাজে লেগে থাকতে হবে। ইসলামের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় সব শ্রেণি-পেশার মুসলমানকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।

সিনিয়র সহ-সভাপতি, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ