সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫ ।। ২০ শ্রাবণ ১৪৩২ ।। ১০ সফর ১৪৪৭

শিরোনাম :
ইসলামি দলগুলোর ঐক্য-সমঝোতা কতদূর? গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগরী উত্তর-এর সমাবেশ  আদর্শিক বিরোধে গণ-অভ্যুত্থানে কারো অবদান অস্বীকার করা উচিত নয় : মাহফুজ আলম ইসলামি চার রাজনৈতিক দলের লিয়াঁজো কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত ‘স্বৈরতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক বন্দোবস্তের স্থায়ী বিলোপের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে’ মোবাইলে লাউডস্পিকারে কথা বলা; ইসলাম কি বলে: শায়খ আহমদুল্লাহ জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনতার বিস্ফোরণ: রাষ্ট্রপতি মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে ড. শোয়াইব আহমদের সৌজন্য সাক্ষাৎ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করবেন প্রধান উপদেষ্টা সব ধরনের দূষণ রোধে আলেম-ওলামার সহযোগিতা চায় সরকার

কেমন হতে পারে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নের রূপরেখা?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: আওয়ার ইসলাম

দেশের কওমি মাদরাসাগুলো বরাবরই অবহেলিত ও উপেক্ষিত। শত বছর ধরে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে গেছে এই শিক্ষাব্যবস্থা—যেখানে রাষ্ট্রের তেমন কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। কওমি মাদরাসার দায়িত্বশীলরা কখনো সরকারের অর্থ সহায়তা চাননি; তারা চেয়েছেন কেবল শিক্ষা ও জ্ঞানের স্বীকৃতি।

অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর ২০১৮ সালে সরকারি স্বীকৃতি মেলে কওমি সনদের। কিন্তু স্বীকৃতি পেলেও সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। কাগজে-কলমে মাস্টার্স স্বীকৃতি থাকলেও বাস্তবে নেই এর কোনো প্রয়োগ।

৫ আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল—দেশে পরিবর্তনের নতুন সূচনা হবে। অনেক ক্ষেত্রে সেই পরিবর্তন এসেছেও। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই পরিবর্তনের ছোঁয়া এখনো লাগেনি কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের জীবনে।

এই প্রেক্ষাপটে আমরা কথা বলেছি তিনজন আলেম ও শিক্ষাবিদের সঙ্গে—যারা নিজেদের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেছেন কওমী স্বীকৃতির বাস্তবায়ন এবং এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে।

এ ব্যাপারে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতির বিশ্লেষক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমার জানা মতে দুবার গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথমবার ২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার সরকার এই স্বীকৃতি দেয় এবং তার ভিত্তিতে গেজেটও প্রকাশিত হয়। কিন্তু কীভাবে এই উদ্যোগটি পরবর্তী সময়ে ঝুলে গেল, তা আমার জানা নেই। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দ্বিতীয়বারের মতো এই স্বীকৃতি দেয়।’

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘যে সরকারই দিক, যেভাবেই দিক—এই স্বীকৃতি কওমি শিক্ষার্থীদের দাওরা সমাপ্তির পর মূলধারার শিক্ষাজগতে স্বীকৃত নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। তবে, এ স্বীকৃতির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাটাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।’

এই বিশ্লেষক বলেন, ‘অনেকে প্রশ্ন তোলেন—দাওরাকে মাস্টার্স সমমান দেওয়ার পরও কওমি শিক্ষার্থীদের কাছে তো গণিত, ইংরেজি, ভূগোল বা সমাজতত্ত্বের মতো জাগতিক জ্ঞান তেমন নেই। তাহলে তাদের দিয়ে কীভাবে দায়িত্ব পালন করানো সম্ভব? আমি বলব, এ প্রশ্ন একেবারে ভিত্তিহীন নয়। তবে এর স্বাভাবিক ও যুক্তিসম্মত উত্তর হচ্ছে—বর্তমানে কওমি মাদরাসাগুলোতে অষ্টম শ্রেণি বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত এসব বিষয়ের পাঠদান হচ্ছে।’

‘যারা মনে করেন কওমি মাদরাসার ছাত্ররা একেবারে জাগতিকভাবে অজ্ঞ, তারা ভুল করছেন। গত ২০-৩০ বছরে কওমি মাদরাসাগুলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এক সময় হয়তো পিছিয়ে ছিল, কিন্তু এখন দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে পিছিয়ে আছে—এ কথা বলার সুযোগ নেই।’

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘দাওরাকে মাস্টার্স স্বীকৃতি একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করেই দেওয়া হয়েছে। তাই আমি বলব—সরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত—যেসব প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় দায়িত্ব রয়েছে, যেমন সেনাবাহিনীতে ইমাম নিয়োগ, সচিবালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও তার শাখাগুলো, বিভিন্ন স্কুলে প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা এবং কলেজে ইসলাম শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিয়োগ—এইসব স্থানে কওমি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে পরীক্ষা নিয়ে বাছাই করাও যেতে পারে। বিশেষ করে হাইআতুল উলিয়ার অধীনে যারা প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হচ্ছে, তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে এই সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘আজকের দিনে কওমি শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরের অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে এবং ভালো ফলাফলও করছে। আমাদের বোর্ডগুলো যদি আরও সক্রিয় ভূমিকা নেয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও উদ্যোগ নেয়—তাহলে এই অগ্রগতি আরও বিস্তৃত হতে পারে। প্রয়োজনে ছয় মাস মেয়াদি প্রস্তুতিমূলক কোর্স চালু করা যেতে পারে। এর জন্য কওমি মাদরাসার অভ্যন্তরেই যথেষ্ট যোগ্য শিক্ষক-প্রশিক্ষক রয়েছেন। যেখানে কওমি ছাত্ররা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে নিজ দেশেই তারা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত—এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। এ বিষয়ে আমি কওমি বোর্ডগুলোর কাছে আন্তরিক আহ্বান জানাই।’

রাজধানীর জামিয়া হোসাইনিয়া আরজাবাদের প্রিন্সিপাল মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া বলেন, ‘দারুল উলুম দেওবন্দ প্রবর্তিত আটটি মূলনীতি কওমি মাদরাসা পরিচালনার কাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই মূলনীতিগুলো মাদরাসার স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা বজায় রাখার ভিত্তি। তবে কওমি মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণকারী কোনো শিক্ষার্থী যদি সরকারি বা বেসরকারি খাতে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির সুযোগ গ্রহণ করেন, তা দেওবন্দি চিন্তাধারার পরিপন্থী নয়। বরং এটি একপ্রকার স্বাভাবিক অগ্রগতি হিসেবেই বিবেচ্য। মাদরাসার শ্রেণিবিন্যাস, পাঠ্যক্রম বা প্রতিটি স্তরের মান নির্ধারণের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে মাদরাসার কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত। এ বিষয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—আমাদের উদ্দেশ্য কী? আমরা যদি লক্ষ্যচ্যুত হই, যদি মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সরকারি বেসরকারি চাকরি বা অন্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি চলচ্চিত্রশিল্পে চাকরি পায়, সেটি শরিয়তের দৃষ্টিতে অনুমোদনযোগ্য নয়, তাই এমন ক্ষেত্র থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়।’

মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া বলেন, ‘তবে সরকার পরিচালিত মসজিদে ইমাম, খতিব কিংবা অন্যান্য হালাল উপার্জনের ক্ষেত্রগুলো গ্রহণযোগ্য এবং সে দিকেই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ। এই চিন্তাকে সামনে রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। সেখানে কওমি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্তকারী শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। শুধু কাজী বা ইমাম নয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক প্রকল্প ও প্রতিষ্ঠানে যাতে তারা নিয়োগের সুযোগ পান—সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এছাড়া আমরা দাবি জানিয়েছি, দাওরা ফারেগ শিক্ষার্থীরা যেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় মাস্টার্স ও এমফিল পর্যায়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু, ফারসি, আরবি সাহিত্য এবং ইসলামের ইতিহাস বিভাগে যেন দাওরা উত্তীর্ণ একজন শিক্ষার্থী যোগ দিতে পারেন—সে বিষয়েও ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এ বিষয়ে সরাসরি সাক্ষাতের প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’

এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী এবং জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ বলেন, ‘কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসকে যে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুটি পথ অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথম পন্থা হলো—বর্তমান প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় সরকারিভাবে যে বিজ্ঞপ্তিসমূহে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান হিসেবে উল্লেখ করা হয়, সেগুলো অব্যাহত রাখা। এতে কওমি মাদরাসা তাদের নিজস্ব কাঠামো বজায় রেখেই স্বীকৃতির আওতায় কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। সিলেবাসের কোনো আমূল পরিবর্তন না করেও, শ্রেণিভিত্তিক স্তর বিন্যাসের মাধ্যমে নিম্নতর ক্লাসগুলোকে সাজানো যেতে পারে। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয়; এর পরবর্তী শ্রেণিগুলোকে আলিয়া মাদরাসার দাখিল ও আলিম সমমান হিসেবে বিবেচনা করে ধাপে ধাপে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের উপযুক্ত মানে উন্নীত করা সম্ভব। প্রয়োজন হলে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে শ্রেণি বিন্যাসের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা যেতে পারে। এতে সময় সংক্রান্ত জটিলতা যেমন বছর কমানো বা বাড়ানোর বিষয়টি সহজেই সমাধানযোগ্য হয়ে উঠবে।’

জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ বলেন, ‘দ্বিতীয় পন্থা হতে পারে—দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের পরিবর্তে অনার্সের সমমান দেওয়া। এমনকি তার চেয়ে সামান্য নিচে নামিয়ে আনলেও বাস্তব ক্ষেত্রে আরও বেশি উপযোগিতা পাওয়া যেতে পারে। এই মানদণ্ডে দাওরা পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনায়াসে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে এবং তাদের যোগ্যতা প্রমাণের ক্ষেত্রেও সুশৃঙ্খল পথ তৈরি হবে।’

ঢাবির এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই দুটি পন্থার যেকোনো একটি অনুসরণ করেই দাওরায়ে হাদিসের স্বীকৃতিকে বাস্তবভিত্তিতে কার্যকর করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন দায়িত্বশীল মহলের সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ ও আন্তরিক প্রয়াস।’

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ