|| শাব্বির আহমাদ খান ||
কুরবানির ঈদ এলেই বদলে যায় কওমি মাদরাসাগুলোর চিরচেনা রূপ। ঈদের দুই তিন সপ্তাহ আগেই শুরু হয় বিশেষ প্রস্তুতি—শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়, কীভাবে কুরবানির দিন গরু জবাই করতে হবে, কীভাবে চামড়া সংগ্রহ করতে হবে। পাশাপাশি হাতে নেওয়া হয় চামড়া কালেকশনের বিশাল কর্মপরিকল্পনা। পোস্টার সাঁটানো হয়, লিফলেট বিতরণ করা হয়, আর ঈদের সকালে ছাত্র-শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে থাকেন রাস্তার মোড়ে, বাড়ির গেটে। উদ্দেশ্য একটাই—চামড়া সংগ্রহ করে মাদরাসার বছরব্যাপী ব্যয়ভার বহন করা।
তবে এই চিত্র কতটা সম্মানের? কতটা দীনের মূল চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা উস্তাদ-ছাত্রদের মুখে জমে থাকা অপমানের গ্লানি কি আদৌ দেওবন্দি ধারার অনুসরণ? যেখানে তাদের ঐতিহ্যে কালেকশনের জন্য ছিল আলাদা ও মর্যাদাপূর্ণ ব্যবস্থাপনা।
এই বাস্তবতায় বিকল্প এক চিন্তার কথা তুলে ধরেছেন জামিআতুল উলূমিল ইসলামিয়া, ঢাকার শায়খুল হাদিস শায়েখ আবুল বাশার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তিনি মনে করেন, ছাত্র-শিক্ষকদের ইজ্জত ও আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য কালেকশন নির্ভরতা কমিয়ে আনা প্রয়োজন। ফিরতে হবে আসলাফদের সেই চেতনায়, যেখানে ইলম ছিল আত্মত্যাগ ও ব্যক্তিত্ব গঠনের মাধ্যম।
এই ভিন্ন চিন্তাধারাই হয়তো হতে পারে মাদরাসা ব্যবস্থার জন্য একটি নতুন দিগন্তের সূচনা।
বর্তমানে আমাদের দেশে মাদরাসাগুলো যেভাবে জনগণের সাহায্য-সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে চলছে, তা অনেকের মতে আমাদের আকাবিরের তরিকার পরিপন্থী। দেওবন্দে এ কাজের জন্য আলাদা মুহাসসিল (সংগ্রাহক) নিয়োজিত থাকতেন। উস্তাদ বা ছাত্রদের দায়িত্ব ছিল না মানুষের দরজায় গিয়ে সাহায্য চাওয়া।
আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায়, উস্তাদ ও ছাত্ররাই কালেকশন করেন। বিশেষত কোরবানির সময় চামড়া সংগ্রহের দৃশ্য অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু লাগে। প্রায়ই দেখা যায়, একই বাড়ির সামনে অসহায় গরিবরা গোশতের জন্য লাইন ধরেছে, আর একজন ছাত্র বা উস্তাদ দাঁড়িয়ে আছেন চামড়ার জন্য। কখনো তারা বাড়ির মালিকের দুর্ব্যবহারের শিকার হন, কখনো অপমানজনকভাবে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এমন অনেক ঘটনা আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। এই চিত্র অনেকের জন্য কষ্টদায়ক ও লজ্জাজনক।
অল্প সময়ে ভালো অর্থ আয়ের কারণে অনেক মাদরাসা কমিটির পক্ষ থেকে এই চর্চা বন্ধ করতে অনীহা প্রকাশ করা হয়। শুধু কোরবানির সময়ই নয়, রমজান মাসেও শিক্ষকরা বাধ্য হন জাকাত কালেকশনের জন্য বাড়ি-বাড়ি ঘুরতে। তারা তাদের ইজ্জত নিয়ে কালেকশন করতে পারছেন কি না, সেটা দেখার যেন কেউ নেই।
হজরত থানবী রহ. বলতেন, ছাত্র তো দূরের কথা, কোনো শিক্ষকও কালেকশনে যাবে না। এমনকি যদি এতে মাদরাসার সংখ্যা কমেও যায়, তবুও তা দীনের জন্য কল্যাণকর হবে। শায়েখ আবুল বাশার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, এই দর্শনের আলোকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি—আমাদের প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষকের ইজ্জত যেন অক্ষুণ্ন থাকে। তারা কারো দরজায় গিয়ে চামড়া বা যাকাত কালেকশন করবে না।
তবে হ্যাঁ, কেউ স্বেচ্ছায় সম্মান রক্ষা করে অংশ নিতে চাইলে নিতে পারে। কোনো প্রকার জবরদস্তি থাকবে না।
তিনি বলেন, আমরা চিন্তা করেছি—অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আসলাফ ও আকাবিরদের যে পদ্ধতি ছিল তা আবার ফিরিয়ে আনা দরকার। ইলম হাসিলের জন্য ছাত্র নিজে খরচ বহন করবে। সালাফে সালেহিনের যুগে অনেকেই তাদের বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ ইলমের পথে ব্যয় করে দিয়েছেন। আমরা সেই রীতিই অনুসরণ করতে চাই।
বিশিষ্ট এই আলেমে দীন বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে মাসিক প্রদেয় ফি মওকুফ হওয়া নির্ভর করবে শিক্ষার্থীর আর্থিক সামর্থ্যের ওপর, নম্বরের ওপর নয়। ভর্তির ক্ষেত্রে নম্বর বিবেচনা করা হবে, তবে মাসিক ফি’র ক্ষেত্রে যার যতটুকু সামর্থ্য, ততটুকুই দেবে। বাকিটুকু প্রতিষ্ঠান বহন করবে।
এইভাবে খরচ করার অভ্যাস শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক হবে। শুধু গ্রহণ করার মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিও সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না, তার মধ্যে শ্রদ্ধা জাগে না। সে অর্থবিত্তের সামনে গলে যায়। এজন্য শুধু যোগ্যতা যথেষ্ট নয়, বরং সেই যোগ্যতার সঠিক ব্যবহারের জন্য ব্যক্তিত্ব গঠনের চর্চাও জরুরি বলে মনে করেন এই বিশিষ্ট আলেম ও শিক্ষাবিদ।
এমএইচ/