২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট। উত্তপ্ত রাজপথ, চোখে-মুখে জেদ আর কণ্ঠে প্রতিবাদের আগুন নিয়ে নেমে এসেছিল দেশের হাজারো তরুণ। এই তরঙ্গের ভেতরে এক অভাবিত দৃশ্য ছিল মাদ্রাসা ছাত্রদের সরব অংশগ্রহণ। ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ছাত্রদের প্রতি প্রচলিত ধারণা ভেঙে দিয়ে তারা জানিয়ে দিয়েছিল, কেবল বেহেশত নয়, এই দুনিয়াকেও দেখতে চায় ন্যায়ের চোখে। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে কয়েকজন কওমি তরুণের অভিজ্ঞতা, যারা সরাসরি এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের বিশেষ প্রতিবেদক কাজী ইনজামামুল হক।
জুম'আর নামাজরত মুসুল্লিদের উপর পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ- আমার হৃদয়কে এতটা আহত করেছিলো যে, আর বসে থাকতে পারিনি: মাওলানা রিদওয়ান হাসান, আহ্বায়ক: সাধারণ আলেম সমাজ
চব্বিশের এই অভ্যুত্থানে প্রথম স্বশরীরে নেমেছিলাম ১৯ জুলাই। যদিও জুলাইয়ের শুরু থেকে এই আন্দোলনের ন্যায্যতা ছিল স্পষ্ট। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের প্রেক্ষিতে এই আন্দোলনের সূচনা। আমি তখনও কোটা সংস্কারের পক্ষে ছিলাম। যদিও কওমি ব্যাকগ্রাউন্ডের হওয়ায় সরকারি চাকরিতে আমরা খুব একটা প্রাসঙ্গিক না। তার উপর আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, তবুও আমার মনে হয়েছে দেশে মেধার অল্টারনেটিভ কখনো কোটা হতে পারে না। ১৯ জুলাই প্রথম স্বশরীরে অংশ নেওয়ার কারণ হলো, জুমার নামাজরত মুসল্লিদের উপর পুলিশের টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ। এটা এতটা আহত করেছিল যে, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি।
এর আগে ১৬ জুলাই রংপুরের আবু সাঈদকে নির্মম হত্যার দৃশ্য এরপর ১৮ জুলাই থেকে সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে কারফিউ জারি করে এবং রাত হলে ব্লকরেইড দিয়ে চলে গণগ্রেফতার। এভাবে সরকারের প্রতিটা জনবিরোধী সিদ্ধান্ত জনগণকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই জুলাই আন্দোলনের ঘটনাক্রমকে তিনভাগে ভাগ করেছি, আমি শুধু আমারটা বলছি, জুলাইয়ের শুরু থেকে আন্দোলন যখন ধীরে ধীরে তীব্র হতে থাকে, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা মৌন সমর্থন দিয়ে গেছে। আমি যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসার গেটের সামনে দেখেছি ছাত্ররা পানি ভরে ভরে বোতলজাত করে রাখছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জন্য।
যাত্রাবাড়ীতে এটা চলে ১৯ জুলাই পর্যন্ত। ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা কিছুটা ছদ্মবেশে নামতে শুরু করে এবং মাদরাসাগুলোতে সেটা মোমের আগুনের মতো এক মাদরাসা থেকে আরেক মাদরাসায় ছড়িয়ে যেতে শুরু করে। এটা চলে প্রায় জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু জুলাই কি শেষ হয়েছিল? ক্যালেন্ডারের পাতায় জুলাই শেষ হলেও সেটা যখন নতুন জুলাইয়ের ইতিহাস রচিত করে, তখন থেকেই প্রতিধ্বনিত হয় স্বৈরাচারের পতন।
মাদরাসা ছাত্রদের অবমূল্যায়ন পুরো আন্দোলনের সাথেই অবিচার। ইতিহাসের এই অন্যায় সংশোধন প্রয়োজন, আমাদের আত্মত্যাগকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া সময়ের দাবি: আবু সুফিয়ান, কলরব
জুলাইয়ের আন্দোলনে নিরীহ মানুষের উপর গুলি চালানো ও নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে আমার ভিতরটা কেঁপে উঠেছিল। চোখের সামনে রক্ত ঝরতে দেখে আর চুপ করে থাকা সম্ভব হয়নি। যেন বিবেকই আমাকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই তখন ছিল সবচেয়ে বড় কর্তব্য। তাই ভয় নয়, প্রতিবাদই বেছে নিয়েছিলাম।
সাইনবোর্ড, যাত্রাবাড়ী, শাহবাগ, টিএসসি চত্বর, শহীদ মিনার—এই প্রতিটি পয়েন্ট আন্দোলনের ইতিহাসে সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে। জুলাই-আগস্টের সেই উত্তাল দিনগুলোতে আমি বুক চিতিয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়েছি। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেছি, গুলির-টিয়ারশেলের মুখে দাঁড়িয়েছি, জীবন বাজি রেখে শ্লোগান তুলেছি—“স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক!” কেউ আহত হয়েছে, কেউ শহীদ, তবু আমরা পিছু হটিনি।
কিন্তু সরকারের পতনের পর, সেই আত্মত্যাগের মূল্যায়ন কই? আজ ইতিহাসে আমাদের নাম নেই, রাষ্ট্রের খোঁজ নেই, দায়িত্বশীলদের স্মরণেও আমরা নেই। যারা রক্ত দিয়েছিল, আজ তারা বঞ্চনার শিকার। আমাদের ত্যাগ যেন বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। এই অবমূল্যায়ন শুধু আমাদের নয়, পুরো আন্দোলনের সাথেই অবিচার। ইতিহাসের এই অন্যায় সংশোধন প্রয়োজন, আমাদের আত্মত্যাগকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া সময়ের দাবি।
বসিলায় হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়েছিল- সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, রাষ্ট্র এখন আকাশ থেকেও ভয় দেখায়: আব্দুল আজিজ, সভাপতি: বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস
২০২৪ সালের ৭ জুলাই থেকেই আমি ও আমাদের সংগঠনের কর্মীরা যোগ দেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক “বাংলা ব্লকেড” আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা চানখারপুলে অবস্থান নেই। এরপর ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দফায় দফায় হামলা চালায়। সেদিনগুলিবর্ষণ ও মারধরের ঘটনায় ২৯৭ জন আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। হামলার পরপরই আমরা পুরোপুরি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হই। বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিসের ব্যানারে বাদ আসর মোহাম্মদপুরে প্রতিবাদ মিছিল করি। মিছিল শেষে কয়েকজন আমরা ঢামেকে আহতদের দেখতে যাই। ফেরার পথে ঢাবি এলাকায় গুলির শব্দ শুনি, সাঁজোয়া পুলিশের গাড়ি ঢুকছে।
পরদিন ১৬ জুলাই আশুরার রোজা রেখে সায়েন্সল্যাব ব্লকেড আন্দোলনে অংশ নেই। প্রবল সংঘর্ষ হয়। আমরা ফাস্ট এইড কিট, শুকনো খাবার ও পানি নিয়ে উপস্থিত ছিলাম। আহতদের অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে হাসপাতালে পাঠানো হয়। অনেক মাদরাসার ছাত্রকে পোশাক খুলে সম্মুখ সারিতে পিকেটিং করতে দেখি। ইফতারের পর মাগরিব নামাজ পড়ে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে যাই- ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান ভাইয়ের খোঁজ নিতে।, সেখান থেকে গভীর রাতে ফিরি। এভাবে জুলাই আগস্টের এই বিপ্লবে প্রায় প্রতিদিনই অংশ নিয়েছি।
বসিলায় হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়—সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, রাষ্ট্র এখন আকাশ থেকেও ভয় দেখায়। শেষে যখন গণভবনের মাটি ছুঁয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়লাম, তখন মনে হচ্ছিল এটি শুধুই আমাদের বিজয় নয়, বরং আত্মদানের পূর্ণতা। এ ছিল এক আন্দোলন, যেখানে আমাদের শরীর ভাঙলেও, আত্মা ছিল অভ্যুত্থানের জয়ে পরিতৃপ্ত।
কওমি শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরির কোটার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না, তবুও ন্যায্যতার পক্ষে তারা রাজপথে নেমে আসে: সা'আদ বিন জাকির, সাধারণ সম্পাদক: ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ
জুলাই-আগস্ট মাসের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান ছিল একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সাহসী প্রতিবাদ, যেখানে ছাত্রসমাজের অগ্রণী ভূমিকায় একটি অনন্য সংগ্রামী ইতিহাস রচিত হয়। এ আন্দোলনে ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করে। যদিও কওমি শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরির কোটার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না, তবুও ন্যায্যতার পক্ষে তারা রাজপথে নেমে আসে।
১১ জুলাই পল্টনে ছাত্র জমিয়তের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে এক মতবিনিময় সভা হয়। এতে কোটা সংস্কারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে আমরা একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে। ১৫ জুলাই রাজু ভাস্কর্যে ছাত্রলীগের হামলায় শিক্ষার্থীরা আহত হলে, ছাত্র জমিয়ত এর তীব্র নিন্দা জানায় এবং আহতদের দেখতে হাসপাতালে যায়। সেখানে ছাত্র জমিয়তের নেতারাও হুমকির মুখে পড়েন।
পরদিন ১৬ জুলাই জরুরি বৈঠকে আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ছাত্র জমিয়তের নেতারা খাবার, চিকিৎসা ও অন্যান্য সহযোগিতার উদ্যোগ নেন এবং দলীয় ব্যানার ছাড়াই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ১৭ জুলাই থেকে পল্টন, উত্তরা, মিরপুর ও বারিধারা-গুলশানে টানা অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু হয়। প্রতিটি পয়েন্টে কেন্দ্রীয় নেতারা সরাসরি নেতৃত্ব দেন।
১৮ জুলাই সংগঠনটি বিবৃতি দিয়ে বলে, প্রশাসনের দমননীতি গণআন্দোলনের শক্তিকে দমাতে পারবে না। ১৯ জুলাই উত্তরা এলাকায় ছাত্র জমিয়তের একটি বিক্ষোভে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং এর পরদিন সংগঠনের একাধিক নেতার ওপর প্রশাসনিক চাপ বাড়ে। সেদিনই ছাত্র জমিয়ত কর্মী মাহদী হাসান গ্রেফতার হন এবং ১৬ দিন কারাভোগ করেন।
৩ আগস্ট গভীর রাতে শাহবাগে ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ছাত্র জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত হন। সেখানে মহাসচিব মাওলানা মনজুরুল ইসলাম আফেন্দী ও সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী জালিম সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান ঘোষণা করেন।
আআন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ দেশের নিপিড়ীত জনগণের স্বাধীনতার জন্যই আমরা লড়েছিলাম। তবে আগস্ট পরবর্তী এই সময়ে মাদ্রাসা ও কওমি ছাত্রদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। কিন্তু রক্ত তো আমরাও দিয়েছি, গ্রেফতার তো আমাদের ভাইয়েরাও হয়ছেন তবে কেন এমন বৈষম্যতা! প্রশ্নের উত্তর হয়ত আমাদেরই খুঁজতে হবে।
এই আন্দোলনে অংশ নেওয়া মাদ্রাসা ছাত্ররা হয়তো সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনাম ছিল না। কিন্তু তারা প্রমাণ করেছে, ধর্মীয় জ্ঞান মানেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা নয়। বরং সেই শিক্ষাই যখন বিবেককে জাগিয়ে তোলে, তখন তা হয়ে ওঠে প্রতিরোধের শক্তি।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলন একদিন ইতিহাসে রূপ নেবে- তাতে কারা নেতৃত্বে ছিল, কারা নিঃশব্দে পাশে দাঁড়িয়েছিল, এসবও লেখা থাকবে। সেই ইতিহাসের পাতায় নিশ্চয়ই থাকবে রিদওয়ান হাসান, আবু সুফিয়ান, আব্দুল আজিজ আর সা'আদ বিন জাকিরদের মতো কিছু কওমী তরুণদের নাম। যাদের চোখে ছিল প্রতিবাদের অগ্নিশিখা, হৃদয়ে ছিল মুক্তির স্বপ্ন।
এমএইচ/