ওয়ালিউল্লাহ আজিজী
ইসরায়েল আর ফিলিস্তিনের যুদ্ধকে এখন কেবল ‘যুদ্ধ’ বললে সত্যের প্রতি অবিচার করা হবে। এটি আর শুধু গোলাবারুদের লড়াই নয়; এটি এখন এক সুপরিকল্পিত, ঠান্ডা মাথার গণহত্যা—যেখানে বিমান থেকে বোমা মারা হয়, খাবার আটকে রেখে মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়। ইসরাইল খাদ্যহীনতা এবং চিকিৎসাবঞ্চনাকে ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে, যা স্পষ্ট মানবতার লঙ্ঘন।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজার ১১১ জন ফিলিস্তিনি ইতোমধ্যে শুধুমাত্র অনাহার ও অপুষ্টিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। এমনকি পাঁচ বছরের নিচে ২১ শিশুর মৃত্যুতথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় নথিভুক্ত হয়েছে। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় শহীদ হয়েছেন ১০০ জন ফিলিস্তিনি, যাঁদের ৩৪ জন ছিলেন ত্রাণ নিতে আসা নিরস্ত্র মানুষ। এ ঘটনা কিছু স্পষ্ট প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে-ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার কোথায়? জাতিসংঘ আজ কোথায়? সারা বিশ্বে মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো আমেরিকা কোথায়? ঠাণ্ডা মাথায় এত ভয়াবহ জাতিগত নিধনের চিত্র যে রাষ্ট্র বা সংস্থা দেখতে পায় না, অথবা দেখেও কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে না,তারা কখনো মানবতার পক্ষের শক্তি হতে পারে না।
ইসরায়েল গাজাকে এক বিশাল মৃত্যপুরীতে পরিণত করেছে। তারা আকাশ থেকে বোমা ফেলছে, মানুষকে আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করছে। আবার ভয়ংকর নরপিশাচের মত সেই আশ্রয় শিবিরেও হামলা করছে। তারা গাজার সমস্ত প্রবেশদ্বার নিয়ন্ত্রণ করছে। দীর্ঘ সময় পর প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য ত্রাণ ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে। আবার সেই ত্রাণ সংগ্রহ করতে আসা নিরস্ত্র নিরীহ ক্ষুধার্ত মানুষদেরকেও গুলি করে মারছে। বিশ্ব ইতিহাসে কোন রাষ্ট্র কখনো এমন ভয়াবহ সাইকোর রুপ নিয়ে পৃথিবীর সামনে আত্মপ্রকাশ করেনি।
চিন্তার বিষয় হল, তারাই হামলা করছে আবার ভেতরের মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও তারাই নির্ধারণ করছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরুরি পরিচালক রস স্মিথ স্পষ্টভাবে বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনী ত্রাণ বিতরণ এলাকায় থাকলে কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়। অথচ ইসরায়েল ত্রাণের নামে নিরীহ মানুষদেরকে জমায়েত করে তারপর চালাচ্ছে গুলি।
গণহারে ক্ষুধা, গণহারে মৃত্যু। এটা ইসরাইলের বর্তমান পলিসি।একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র এমন ভয়াবহ পলিসি গ্রহণ করেনি, কারো পক্ষে করা সম্ভবও না।
আল–জাজিরার সাংবাদিক তারেক আবু আজ্জুমের ভাষায়, ‘এটি একটি পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ’।
গাজার ঘরে ঘরে এখন চলছে ধীরে ধীরে মৃত্যুর প্রতীক্ষা। কেউ খাবার পাচ্ছে না, আবার যারা পাচ্ছে, তাদের ঘাড়ে ঝুলছে মৃত্যুর ছায়া। কারণ পরেরবার ত্রাণ আনতে গেলে সে ফিরবে কিনা জানে না। এটা কোনো যুদ্ধ নয়, এটি ঠান্ডা মাথায় জাতিগত নিধন। এটি ইহুদিদের নীতিগত নিষ্ঠুরতা।
১১১টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা একযোগে বলছে, গাজার বাইরে টনকে টন খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী থাকলেও ইসরায়েল সেগুলো ঢুকতে দিচ্ছে না। এই তথ্যগুলো আর কোনো সংশয়ের অবকাশ রাখে না—ইসরায়েল একটি ‘মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ’কে যুদ্ধনীতির অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে।
গাজা পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর কারাগার
খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা—সব বন্ধ করে দিয়ে একটি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেওয়া, এটাই এখন বাস্তবতা। গাজার শিশুদের কঙ্কালসার শরীর, হাসপাতালের ফ্লোরে ছটফট করতে থাকা অপুষ্ট দেহগুলো আমেরিকার সভ্যতা, জাতিসংঘ আর তথাকথিত মানবাধিকারের মুখে সপাটে চপেটাঘাত করছে প্রতিনিয়ত।
এখন সময় এসেছে মুসলিম বিশ্বকে সত্যিকারের ভূমিকা পালনের। শুধু উদ্বেগ, নিন্দা ও বিবৃতি নয়—চাপ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিরোধই এখন সময়ের দাবি। কারণ ফিলিস্তিনে এখন শুধু মানুষ মরছে না, মরছে মানবতা,মরছে নৈতিকতা। অসহায়দের বুকফাটা আর্তনাদে ডুকরে কাঁদছে বিশ্ববিবেক এবং বিশ্বসভ্যতা।
ক্ষুধা এখন অস্ত্র, যার ট্রিগার রয়েছে ইসরাইলের হাতে। ইচ্ছা হলে সে ক্ষুধার ট্রিগার চেপে দিয়ে মানুষ হত্যা করছে। এমন নির্মমতা ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। বিশ্ববাসী যদি এখনো না জাগে, তাহলে হয়তো ইতিহাসের পরবর্তী পাতাগুলোতে লেখা থাকবে—"বিশ্বমানবতা গাজায় চরমভাবে পরাজিত হয়েছিল!"
লেখক: ফাজেল, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া
অনার্স, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
এমএইচ/