সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫ ।। ২০ শ্রাবণ ১৪৩২ ।। ১০ সফর ১৪৪৭

শিরোনাম :
ইসলামি দলগুলোর ঐক্য-সমঝোতা কতদূর? গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগরী উত্তর-এর সমাবেশ  আদর্শিক বিরোধে গণ-অভ্যুত্থানে কারো অবদান অস্বীকার করা উচিত নয় : মাহফুজ আলম ইসলামি চার রাজনৈতিক দলের লিয়াঁজো কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত ‘স্বৈরতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক বন্দোবস্তের স্থায়ী বিলোপের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে’ মোবাইলে লাউডস্পিকারে কথা বলা; ইসলাম কি বলে: শায়খ আহমদুল্লাহ জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনতার বিস্ফোরণ: রাষ্ট্রপতি মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে ড. শোয়াইব আহমদের সৌজন্য সাক্ষাৎ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করবেন প্রধান উপদেষ্টা সব ধরনের দূষণ রোধে আলেম-ওলামার সহযোগিতা চায় সরকার

চামড়ার দামে কারসাজি নিয়ে কী ভাবছেন আলেমরা?


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

|| মোহাম্মাদ হুজাইফা ||

প্রতি বছর ঈদুল আজহায় দেশের বেশির ভাগ কওমি মাদরাসা কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের আয়োজন করে থাকে। এসব চামড়া বিক্রির অর্থ দিয়ে পরিচালিত হয় লিল্লাহ বোর্ডিং ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে গরিব, এতিম ও অসহায় ছাত্রদের জন্য ফ্রি খাবার ও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার দাম নিয়ে বড় ধরনের কারসাজি হয়ে আসছে। এবারও তেমনটাই হয়েছে। এতে মাদরাসাগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজির প্রেক্ষাপটে নানা প্রশ্ন উঠছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি পরিকল্পিতভাবে চামড়ার বাজার ধ্বংসের মাধ্যমে মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংব্যবস্থা দুর্বল করার অপচেষ্টা। কেউ কেউ বলছেন, মাদরাসাগুলোর চামড়া কালেকশনের বিকল্প ভাবা উচিত।  

এ বিষয়ে বিশ্লেষণ করে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মাদরাসার নাজিমে তালিমাত মুফতি আশরাফুজ্জামান আওয়ার ইসলামকে বলেন— ‘চামড়া শিল্প একসময় আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত ছিল। বর্তমানে এই শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে, যার প্রভাব মাদরাসাগুলোর ওপরও পড়েছে।’

তবে চামড়ার দরপতনের আরেকটি দিক তুলে ধরেন তিনি। তার মতে ‘আগে যখন চামড়ার দাম বেশি ছিল, তখন চামড়া সংগ্রহে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা, সংঘর্ষ ও ঝুঁকি ছিল। স্থানীয় কিছু যুবক চামড়া দখলে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তো। কিন্তু এখন সেই ধরনের পরিস্থিতি নেই। চামড়ার দর কম থাকায় মাদরাসাগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক চামড়া পায় এবং সেটা নিরাপদে সংগ্রহ করতে পারে। টাকার পরিমাণ কম হলেও ঝুঁকিহীন।’

বিশিষ্ট এই আলেম বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পেছনে চামড়া প্রস্তুত কেন্দ্রগুলোর অপরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশগত দুর্বলতার কথা অনেকে বলে থাকেন। এর ফলে বিদেশি ক্রেতারা আগ্রহ হারাচ্ছে। এখানে রাষ্ট্রের নীতিগত উদ্যোগ জরুরি। ট্যানারি শিল্পকে পরিবেশসম্মত না করলে রপ্তানিতে আগ্রহ আসবে না। এছাড়া সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার জন্যও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।’

আলেম সমাজের ভূমিকা প্রসঙ্গে মুফতি আশরাফুজ্জামান বলেন— ‘অনেকে বলেন উলামায়ে কেরাম একত্রিত হয়ে নিজস্ব ট্যানারি গড়ে তুলুক। আমি মনে করি, এককভাবে আলেমদের পক্ষে এমন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব নয়। তবে তারা রাষ্ট্রের কাছে এসব সমস্যা তুলে ধরতে পারে, সেটাই তাদের করণীয়।’

চামড়ার দামে প্রহসনমূলক অবস্থা ও এর স্থায়ী সমাধান নিয়ে মতামত দিয়েছেন জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মুফতি সাঈদ আহমদ। তিনি বলেন—  কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পবিত্র কোরবানির ঈদে চামড়া সংগ্রহের ইতিহাস আমার জানা নেই। তবে ছাত্র জামানা থেকে দেখে এসেছি চামড়া সংগ্রহের এ প্রচলন কখনোই সম্মানজনক ছিল না।

তিনি জানান, চামড়ার দাম যখন বেশি ছিল তখন রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের মোকাবেলা করে চামড়া সংগ্রহ করা ছিল বিপজ্জনক। বিভিন্ন এলাকায় মাদরাসা শিক্ষার্থীরা এলাকার প্রভাবশালীদের আক্রমণের শিকার হতো।  

বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় মাদরাসাগুলো এখন তুলনামূলকভাবে বেশি চামড়া পাচ্ছে। এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক চক্রের মোকাবেলার চাপও নেই। এতে সংগ্রহ নিরাপদ হয়েছে ঠিকই কিন্তু শিক্ষার্থীদের ঈদের আনন্দ বিসর্জন দিয়ে সামান্য অর্থের জন্য চামড়া সংগ্রহে নামা এখনো মোটেই সম্মানজনক নয়।

তিনি আরও যোগ করেন, বর্তমানে মাদরাসাগুলোর ছাত্রদের মধ্যে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। ফলে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থী এই চিত্রকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছেন না।

অনুদান সংগ্রহে মাদরাসার করণীয় বিষয়ে মুফতি সাঈদ আহমদ বলেন— মাদরাসার প্রয়োজনীয়তার কথা সমাজের সামনে তুলে ধরতে হবে। তবে প্রয়োজনের জন্য দরজায় দরজায় গিয়ে সাহায্য চাওয়া তাকওয়ার পরিপন্থী। এ পন্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা জরুরি; যদি চামড়ার বাজারে পুরনো স্বর্ণযুগ ফিরে আসে তবুও বের হয়ে আসা জরুরি।

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন— আল্লাহ তায়ালা সম্মানজনক রিজিকের ব্যবস্থা করবেন, যদি আমরা সঠিক পথে থাকি। আমাদের উচিত, অর্থ সংগ্রহের পথ যেন ইজ্জতের পরিপন্থী না হয়, তা নিশ্চিত করা।’

চামড়ার দাম ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়ায় দেশের কওমি মাদরাসাগুলো  ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মুফতি মাহমুদ হাসান মাসরুর। তিনি বলেন, চামড়ার দাম কমে যাওয়ার ফলে মাদরাসাগুলোর মূল দাতব্য চরিত্র ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আগে যেভাবে ছাত্রদের বিনামূল্যে খাবার ও আবাসন সুবিধা দেওয়া হতো, এখন তা পূর্ণরূপে বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

মুফতি মাহমুদ হাসান মাসরুর বলেন, ‘একদিকে চামড়ার মূল্য হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে জাকাত, সদকা ও দানও উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে মাদরাসাগুলোকে তাদের খরচের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ অর্থ ছাত্রদের কাছ থেকেই আদায় করতে হচ্ছে। এতে করে নিম্নবিত্ত ও দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারের সন্তানরা দ্বীনি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অথচ এক সময় কোরবানির চামড়া বিক্রি করেই লিল্লাহ বোর্ডিং-এর বড় একটি অংশের খরচ নির্বাহ করা সম্ভব হতো। এখন সেই সুযোগ আর নেই।’

মুফতি মাহমুদুল হাসান অভিযোগ করে বলেন, ‘চামড়ার মূল্য কমে যাওয়ার ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ছাত্রদের দীনি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকির দায় সমাজপতি ও ধনী শ্রেণির মানুষদেরও নিতে হবে। তারা যদি যথাযথভাবে সহযোগিতার হাত না বাড়ান, তাহলে ক্ষতির দায় এককভাবে রাষ্ট্রের নয়।’

চামড়ার বাজার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সরকার চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা সেই ধার্যকৃত ন্যায্য মূল্যে চামড়া কিনছে না। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, এখনো সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়ীদের ওপর পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। এটা দেশের জন্য এবং সাধারণ মানুষের জন্য উদ্বেগজনক। আমি মনে করি, চামড়ার বাজারে সক্রিয় সিন্ডিকেটের ওপর বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন।’

লেখক: সাব এডিটর, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম।
শিক্ষক, মাদরাসাতুল কুরআন লিল বানাত।

এমএম/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ