যুবায়ের আহমাদ
মরহুম পীর সাহেব চরমোনাই ফজলুল করীম (রহ.) যখনই কিশোরগঞ্জ আসতেন, তাঁর বিশ্রামকক্ষের খেদমতে থাকতাম। তাঁর কথায় দরদ ও আন্তরিকতা থাকতো তাতে মুগ্ধ হতাম। বর্তমান পীর সাহেব এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতাও ভালোলাগার। তাঁর কাছে যৌক্তিক কোনো বিষয় উপস্থাপন করলে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে তা বিবেচনা করেন, অন্যকে সম্মান করেন। কর্মসূচি দেবার ক্ষেত্রেও খুব কৌশলী অবস্থান আমার ভালো লাগে। ধীরগতি। শুরুতেই উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য বা কর্মসূচি না, প্রথমে স্মারকলিপি, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ, জনসমর্থন তৈরি তারপর বড় কর্মসূচি। তাঁর সময়ে ইসলামী আন্দোলন দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত। জুলাই আন্দোলনে সরাসরি নিজেদের দলের ব্যানারে সব হুমকি উপেক্ষা করে মাঠে নামাও ছিল অনেক ইতিবাচক। কাজ করলে ভুল হবে। ভুল তাদের যে নেই তা না। আমি তাদের ভুলেরও সমালোচনা করি। কিন্তু পীর সাহেব ও তাঁর রাজনৈতিক সহযোগীদের বড় সাফল্য হলো, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে নানারকম গ্রুপে বিভক্ত, সেখানে ইসলামী আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বিভক্তি থেকে আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত দূরে রাখতে পেরেছেন।
তবে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ইসলামী বিপ্লবের উপযোগী দক্ষ ও আমানতদার হিসেবে গড়ে তুলতে অনেক সময় লাগবে বলে মনে করি। সমর্থক কর্মীরা ওই পর্যায়ের আমানতদার হবে দলের নীতির কঠোরতার ভিত্তিতে৷ তরবিয়তের মাধ্যমে। রিপোর্ট ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে। কেউ একজন চরমোনাই গিয়ে টুপি পাগড়ি আর জোব্বা পরা শুরু করে দেবে এটা যতটা সহজ, আচরণ ও লেনদের পরিবর্তন অনেকসময় দ্রুততম সময়ে হয় না। আস্তে আস্তে হয়; হচ্ছে।
অন্যদিকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। দেশ ও জাতির নানা সংকটে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তৃণমূলে কর্মীসংখ্যা তুলনামূলক কম থাকলেও রাজনৈতিক দক্ষতার বিবেচনায় বড় বড় জাতীয় নেতা তৈরি হয়েছে জমিয়ত থেকে। শত শত রাজনীতিকদের পড়ানোর মতো যোগ্য যোগ্য আলেম এখনো নেতৃত্বে আছেন। বর্তমান সভাপতি আল্লামা উবাইদুল্লাহ ফারুক হাফি.র মতো বড় আলেমকে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। আমি উভয় সংগঠনকে ভাতৃত্বের জায়গায় দেখতে চাই! কেউ কারো প্রতিপক্ষ না হোক! রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকবে, একে অন্যের গঠনমূলক সমালোচনাও করবে, কিন্তু তা হওয়া উচিত শালীনতা ও শ্রদ্ধা বজায় রেখে।
পিআর পদ্ধতি ফরজ কিছু নয়। অনেকগুলো ভালো দিক যেমন আছে, মন্দ দিকও আছে। আমাদের দেশের বাস্ততায় এর দ্রুত বাস্তবায়নও কঠিন বলে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়। এ নিয়ে আরো আলোচনা হোক, পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক হোক, টকশো হোক, কী কী দুর্বল দিক আছে, এতে কী কী সমস্যা আছে সেগুলো সমাধানে কী কী করা যেতে পারে, গণমানুষের ভাবনা কী, তা নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা হোক, কিন্তু পিআরের পক্ষে বললে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন আর বিপক্ষে বললে বিএনপির দালাল এসব বলা খুবই দুঃখজনক। পিআরের পক্ষে বললেই ছোট দল আর বিপক্ষে বললেই বড় দল এসব কোন ধরনের কথা?
সব বিষয়ে সবাই একমত হবেন তা ভাবা ভুল। আবার আমার কিংবা অন্যের কোনো মত প্রতিষ্ঠিত হয়েই যাবে, এটা ভাবাও ভুল। কেউ একজন আমার মতের বিরুদ্ধে বলছে, বলুক না! আমার মতের বাইরেও কোনো মত থাকতে পারে, আমার চিন্তার বাইরেও চিন্তা থাকতে পারে, সেটিও সঠিক হতে পারে এমন বিশ্বাস রাজনীতিকদের থাকা উচিত।
কিছু হতে না হতেই একে অন্যকে অমুক-তমুকের দালাল বললে সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামি দলগুলো হাস্যরসের খোরাকে পরিণত হয়। শুধু জমিয়ত আর চরমোনাই বা ইসলামী আন্দোলনই নয়, অনেক রাজনৈতিক দলের কর্মীদের দেখি, অন্যকে উপহাস বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলতে, পোস্ট করতে। এতে ওই কর্মী বা কথিত নেতার অবস্থান জানা যায়। দেখবেন, বেশি লাফালাফি যারা করে, ওদের তেমন কোনো পদ নেই। খানিকটা ভুঁইফোড় নেতা। আমি পোস্ট দেখেই বুঝতে পারি, এরা কোন লেভেলের নেতা। বিএনপি দীর্ঘ সময় ইসলামপন্থীদের সাথে ছিল। এর নেতাকর্মীদের বড় একটা অংশ ইসলামি ভাবাপন্ন। কিন্তু বিএনপি বা তাদের অঙ্গসংগঠনের যেসব কথিত নেতা সবসময় ফেসবুকে শুধু ইসলামি দলের শীর্ষনেতাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করতেই ব্যস্ত থাকে। ওদের কী পদ আছে তা জানার দরকার হয় না। পোস্ট দেখেই বোঝা যায় কোন লেভেলের নেতা। টোকাই নেতা, নাকি ভালো কোনো পদপদবি আছে৷ ঠিক ইসলামি দলগুলোরও কিছু অতিউৎসাহী আছে, যাদের উল্লেখযোগ্য কোনো পদপদবি নেই। চোখে অন্যদলগুলোর ভালো কিছু পড়ে না। শুধুই মন্দটা দেখে। সমালোচনা করতে গিয়ে শ্রদ্ধাবোধ রাখেন না। যখন সমালোচনা করেন, তখন সমালোচনাই, যখন প্রশংসা করেন তখনও সীমালঙ্ঘন করেন।
এসব ফেসবুক সমর্থকদের সমর্থন লাভের আশায় অনেক সময় বড় নেতারাও প্রভাবিত হয়ে পড়েন। ইসলামি অঙ্গনে এসব বন্ধ হোক, পারস্পরিক শ্রদ্ধার জায়গাটা আরও শক্তিশালী হোক! ভিন্নমত, সমালোচনা চলুক কিন্তু শ্রদ্ধা ও সীমারেখা বজায় রেখে।
লেখক: কলামিস্ট, মাদরাসা শিক্ষক ও চিন্তক
এমএইচ/