সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫ ।। ২০ শ্রাবণ ১৪৩২ ।। ১০ সফর ১৪৪৭

শিরোনাম :
ইসলামি দলগুলোর ঐক্য-সমঝোতা কতদূর? গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগরী উত্তর-এর সমাবেশ  আদর্শিক বিরোধে গণ-অভ্যুত্থানে কারো অবদান অস্বীকার করা উচিত নয় : মাহফুজ আলম ইসলামি চার রাজনৈতিক দলের লিয়াঁজো কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত ‘স্বৈরতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক বন্দোবস্তের স্থায়ী বিলোপের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে’ মোবাইলে লাউডস্পিকারে কথা বলা; ইসলাম কি বলে: শায়খ আহমদুল্লাহ জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনতার বিস্ফোরণ: রাষ্ট্রপতি মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে ড. শোয়াইব আহমদের সৌজন্য সাক্ষাৎ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করবেন প্রধান উপদেষ্টা সব ধরনের দূষণ রোধে আলেম-ওলামার সহযোগিতা চায় সরকার

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন: ব্যর্থতা, পক্ষপাত ও ষড়যন্ত্রের আড়াল

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কাজ হলো, বিশ্বের সব দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করা। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি সুপারিশ দেওয়া। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও নীতি প্রচার ও রক্ষা করা। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বিভিন্ন special rapporteur ও working group গঠন করা নির্দিষ্ট ইস্যুতে কাজ করার জন্য। 

কিন্তু বাস্তবতা হলো— এ প্রতিষ্ঠান নিজে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। বরং কথার ফুলঝুরি ও সুপারিশ আর রাজনৈতিক চাপের ভান করে চলে। আফগানিস্তান, ডিআর কঙ্গো, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইউক্রেন, প্যালেস্টাইন, হাইতিসহ কিছু দেশে অফিস খোলার পরও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি।

যে সব দেশে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে সেখানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন কার্যকর কোন ভূমিকা রাখছে না। বরং কোনো কোনো দেশে মানবাধিকারের ছদ্মাবরণে সে দেশের ধর্মীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিরোধী প্রোপাগান্ডা চালিয়ে থাকে। বিশ্বদরবারে সে দেশকে উগ্র সাম্প্রদায়িক পশ্চাৎপদ একটি দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার হীন চেষ্টা করে।

এছাড়াও সোমালিয়া, ডিআর কঙ্গো, রুয়ান্ডা, হাইতিসহ কিছু দেশে অনেক ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগের মুখে পড়েছে। অনেক দেশে তাদের উপস্থিতিকে সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। মিয়ানমার, সিরিয়া, ফিলিস্তিনে তারা নির্যাতিত মানুষের জন্য কথা বললেও বাস্তবে কোনো দৃশ্যমান ফল আসেনি; বরং রাজনৈতিক বিরোধ তীব্র হয়েছে। নির্যাতনের মাত্রাও বেড়েছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার কথিত তথ্য প্রকাশ করে ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুরকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। রুয়ান্ডায় গণহত্যা ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সোমালিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালে মানবাধিকার কর্মসূচি চালু করে। কিন্তু সেখানে কার্যত কোনো শান্তি বা সুরক্ষা নিশ্চিত করে করতে পারেনি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করলেও জাতিসংঘ কোনো শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। ফিলিস্তিনে গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরাইলি আগ্রাসন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘনের নিন্দা করলেও কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ জাতিসংঘ গ্রহণ করেনি। এতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়।

মুসলিম দেশগুলোতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে; বরং কোনো কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের উস্কিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার সংরক্ষণের কথা বলে অনুপ্রবেশ করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। কেবল লোক দেখানো মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি রিপোর্ট পেশ করে থাকে।

মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গাদের গণহত্যা ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির বিরুদ্ধে বহু প্রতিবেদন দিলেও কার্যত কোনো সামরিক বা অর্থনৈতিক চাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আজও পৃথিবীর নানা দেশে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। শুধু বাংলাদেশেই দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম শরনার্থী রয়েছে। অথচ জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযান চালায় নি এবং অর্থনৈতিক অবরোধের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

ফিলিস্তিনে জায়নবাদী ইসরাইল যুগ যুগ ধরে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। এর বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। সম্প্রতি গাজা ও পশ্চিম তীর বোমার মেরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে চলছে। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো ইসরাইলকে সহযোগিতার অভিযোগ বিশ্বসংস্থার বিরুদ্ধে রয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন হামলার সময় মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে। কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে রিপোর্ট করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত নেয়নি। লিবিয়ায় ন্যাটোর হামলার পর মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম অবনতি হতে থাকে। এক্ষেত্র জাতিসংঘ কার্যকর কোনো সমাধান দিতে পারেনি। বরং লিবিয়ার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়।

জাতিসংঘের উপর যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া চীনসহ ভেটো পাওয়ারের অধিকারী দেশগুলো রাজনৈতিকভাবে চরম প্রভাব রয়েছে। যার ফলে নির্যাতিত দেশ বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর পক্ষে জাতিসংঘ কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনা। মুসলিম দেশগুলোর সাথে বিমাতাসূলভ আচরণ করা হয়। বরং শান্তির নামে অশান্তির বিষাক্ত বীজ বপন করা হয় এ সব দেশে। 

পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে সর্বোচ্চ পর্যায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় তার মধ্যে ভারত অন্যতম। ভারতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কোনো দপ্তর নেই। এ ব্যাপারে জাতিসংঘকে কোনো কার্যকরী ভূমিকা নিতেও দেখা যায় না। গোমাংস রাখার মিথ্যা অভিযোগে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা ভারতে অহরহ ঘটছে। এ জাতীয় অমানবিক ঘটনা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরগুলোতেও হর হামেশা ঘটতে দেখা যায়।  এত লোমহর্ষক ঘটনার পরও জাতিসংঘ নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় যদি খুলতে হয় তাহলে গুরুত্বের বিবেচনায় ভারতের খোলা দরকার। কিন্তু সেখানে না খুলে রহস্যজনক কারণে বাংলাদেশে খোলা হল, ফলে দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের কপালে চিন্তার রেখা ভেসে ওঠেছে। কথিত মানবাধিকার কমিশন না আবার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে? এ আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

মুসলিম সমাজের পারিবারিক রীতিনীতি এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান, বিয়ে-শাদী, পোশাক-আশাক সম্পর্কে পশ্চিমা দুনিয়া নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে থাকে। মুসলিম পারিবারিক আইনকে অনেক ক্ষেত্রে মানবাধিকারে হস্তক্ষেপ বলে তারা অপপ্রচার চালায়। কোথাও কোথাও সমকামিতার বিরোধিতাকেও মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে প্রোমোট করে থাকে। হিজাব প্রথাকেও মানবাধিকার বিরোধী বলে ইসলাম ধর্মের অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিধান সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়ে থাকে। 

বাংলাদেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের কার্যালয় খুলতে হবে। বর্তমান ইন্টেরিম সরকার মুখে মুখে মিষ্টি কথা বললেও সুকৌশলে এমন কিছু কাজ করছে যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসাধারণের বোধ-বিশ্বাস, তাহযিব-তামাদ্দুন বিরোধী। যত দিন যাচ্ছে ততই তারা এ কাজগুলো ঠান্ডা মাথায় করে যাচ্ছে। ঐক্যমতের সংলাপের নামেও এক ধরনের সময় ক্ষেপণ করে চলেছে। বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পর তর্কযুদ্ধে ব্যস্ত রেখে তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অগ্রসর হচ্ছে বলে কেউ কেউ বলতে চাচ্ছেন।

লেখক: মুহতামিম, জামিয়া হোসাইনিয়া আরজাবাদ, সহ-সভাপতি, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ