ওসামা বিন আফজাল
৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির জন্য এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। বলা যায়, এটি মরা গাঙে নতুন জোয়ারের মতো এসেছে। এখন এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে ইসলামী দলগুলো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরতে পারে। আগের মতো আর সমাবেশ কিংবা প্রোগ্রামের অনুমতির জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ডিসি-ওসির অনুগ্রহের অপেক্ষায় থাকতে হয় না। ফ্যাসিস্ট হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালে ইসলামী রাজনীতিবিদদের ত্যাগ এবং তাদের অবদান দেশের জনগণ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে। এজন্য তারা এখন ইসলামিস্টদের মধ্যে ইনসাফ ও ন্যায়ের প্রকৃত সন্ধান পেতে শুরু করেছে। নতুন কিছু প্রত্যাশা ডানা মেলতে প্রস্তুত, এবং এখন সেই সুযোগও রয়েছে।
তবে এখন প্রশ্ন উঠছে, ইসলামিস্টগণ কীভাবে সেই মহা সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছেন? বা জনগণের আস্থার জায়গা তারা কতটা ধরে রাখতে পারছেন? তারা কি দলাদলি এবং মান-অভিমান ভুলে ইসলাম ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মিলেমিশে একাকার হতে পেরেছেন? তারা কি জনগণকে এই বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছেন যে, আমরা জামায়াত, জমিয়ত, চরমোনাই, খেলাফত এই সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে একমাত্র ইসলামী শাসনব্যবস্থার খাদেম? যদি তারা নিজেদের মাঝে ইসলামী রাজনীতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য সাধন করতে না পারেন, তবে তারা কীভাবে জনগণকে ইসলামী রাজনীতির জন্য এক কাতারে আনবেন?
৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত খুব বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি। তবে সময় কিন্তু ফুরিয়ে আসছে। সময়ে শেষ হওয়ার আগেই নিজেদের জনগণের সামনে ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংগঠিত হিসেবে উপস্থাপন করতে না পারলে, জনগণ আমাদের কাছ থেকে হাত গুটিয়ে নেবে। মানুষের মাঝে তিক্ততা বাড়বে। ইতোমধ্যেই তো তারা ইসলামী দলের অনৈক্য নিয়ে হাস্য-তামাশা করা শুরু করেছে। মানুষের মাঝে হতাশা কাজ করে, তবে এই সুবর্ণ সুযোগেও যদি তাদের হতাশা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং নিজেদের ব্যর্থতা আবারও প্রমাণিত হয়, তাহলে আমাদেরকে দীর্ঘ সময় ধরে এর গ্লানি টানতে হবে।
সামান্য একটি বা দুটি আসন পাওয়ার জন্য আমরা আর কতকাল নিজেদের পানি অন্যের ক্ষেতে সিঞ্চন করব? এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমরা যারা ইসলামী শাসনব্যবস্থা চাই, আমাদের লড়াইটা তাদের বিরুদ্ধে, যারা ইসলামী শাসনব্যবস্থা চায় না। সুতরাং, অন্তত এই স্বার্থে আমাদের এক হওয়া উচিত। কিন্তু যদি আমরা ইসলামবিদ্বেষী শক্তির লাঠিয়াল হয়ে কাজ করি, তবে এটি হবে আমাদের আদর্শ ও চেতনার সাথে চরম গাদ্দারি। এটা জনগণের চাহিদার বিরুদ্ধে অবস্থান।
আমরা কি দলের রাজনীতি করি, না ইসলামের রাজনীতি- এটি প্রমাণিত হবে আমাদের কর্ম দ্বারা। ইসলামী ঐক্যের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা যদি দলীয় স্বার্থ মাড়াতে পারি, তাহলে আমরা ইসলামের রাজনীতি করি। আর অন্যথায়, আমরা দলের রাজনীতি করি।
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দলীয় রাজনীতিতে কোনো সওয়াব নেই। উল্টো হাদিসে এর জন্য হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
অর্থ, তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং একে অপরের মাঝে বিভক্ত হয়ে পড়ো না।
মহান আল্লাহ তায়ালার এই বাণী এড়িয়ে গিয়ে আমরা কি কখনও সফল হতে পারব? আল্লাহ তায়ালার হুকুম অমান্য করে রক্তগরম করা ভাষণে খিলাফা শব্দের খই ফোটানো নিছক বোকামি এবং পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়।
আমাদের বর্তমান অবস্থাও এমন, যে আমাদের কর্ম দ্বারা প্রকাশ পাচ্ছে- واعتصموا بحبلي ِللَٰه جميعا .অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর জন্য আমার রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো-এর মত স্বার্থপর আকাঙ্খা। এটি খুবই দুঃখজনক এবং আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়।
আমরা আর কতকাল অন্যের ক্ষমতার সিঁড়ি হবো? ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া বস্তু হবো? এবার একটু ভাবার সময় এসেছে।
সামান্য ফায়দার জন্য সাময়িক ঐক্য গঠন বা চাহিদার বিপরীতে গিয়ে অন্য কারো সাথে জোটবদ্ধ হওয়া বিশাল ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
নৌকা আর ধানের শীষের দুই সাপের এক বিষ থেকে অনেক মানুষ মুক্তি পেতে চায়। এখন, সেই মুক্তিকামী মানুষের সংখ্যা আরও বাড়ানোর জন্য আমাদেরকে মেহনত করতে হবে, নিজেদের কাঁদা ছোড়াছুড়ি থেকে মুক্ত করে আরও সুসংহত করতে হবে। এক লক্ষ্য-এক স্বপ্নে নিজেদের একাকার করতে হবে।
বিএনপি এখন আওয়ামি লীগের সেই পুরাতন ভাঙা ক্যাসেট নিয়ে হাজির হয়েছে। ৫ আগস্টের দ্বিতীয় দিনের মাথায়, একদম প্রথম সম্মেলনেই বিএনপি ইসলামী পন্থীদেরকে মৌলবাদ ইত্যাদি শব্দ দিয়ে কটূক্তি করেছে। রাজাকার, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি—এই সব ফ্যাসিস্টের তৈরি করা শব্দ বাজিয়ে বাজিয়ে আমাদেরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে।
সময়টা বসন্তের! বসন্তও কিন্তু ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে। বেলা ডুবার আগেই এই বসন্তকে কাজে লাগিয়ে অপ্রতিরোধ্য ঐক্য গড়ে তুলতে না পারলে, ইসলামী দলগুলোকে চরম মাশুল গুনতে হবে।
কুমিল্লা
এমএইচ/