সোমবার, ০৫ মে ২০২৫ ।। ২২ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ৭ জিলকদ ১৪৪৬


কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ রহ.: কী রূপে বাঁধব তাকে: মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন।।

প্রাচীন ইতিহাসের আধুনিক উপমা। হযরত মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ রহ.। প্রাচীন ইতিহাসের অপরকাল ভাবনা যাদের পার্থিব জীবনকে সদা পরাজিত করে গেছে। যুগে যুগে সেই কাফেলার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার ছাত্র, সহকর্মী ও সমকালীনদের মাঝে জ্ঞানের বৈচিত্র্য ও গভীরতায় কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ ছিলেন তার অনন্য উপমা।

ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস, দর্শন ও অথৈ জ্ঞানভাণ্ডার ছিল তাঁর নখদর্পণে। দীনী ইলমের গভীর পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস সাহিত্য-সংস্কৃতি সবই ছিল তাঁর সাধনার অধীন। অসামান্য ধীমান প্রবাদপ্রতিম এই জ্ঞানসমুদ্র যেমন ছিলেন নিভৃতচারী, তেমনি অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত।

তার সর্বজনবিদিত এই সকল গুণ ও যােগ্যতাকে ছাপিয়ে গেছে যে তিনটি অনন্য বৈশিষ্ট্য, তা হল- এক, বিশ্বাসে। আপােষহীনতা, দুই. বিনয়দীপ্ত আখলাক, আর তিন. পূর্বসূরিদের শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার-দরবেশি!

স্বীকার করি, আমি হযরত মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর পারিভাষিক ছাত্র নই। তবে তাঁর কাছের এবং একান্ত অনেক ছাত্রের ছাত্র। তাছাড়া ছাত্র হওয়ার জন্যে যদি কাড়ি-কাড়ি বই পড়ার প্রয়ােজন না হয় তাহলে বলব, বুখারী শরীফের প্রথম ও শেষ হাদীস তার কাছে অনেকবার পড়েছি এবং ছাত্র হওয়ার মানসেই পড়েছি। তাই কেউ যদি আমাকে তার সম্মানিত ছাত্রদের কাফেলায় ঠাঁই দেন, আমি তাতে গৌরব বােধ করব।

তারিখ মনে করতে পারব না, প্রথম তাকে কবে দেখি! তবে কাছ থেকে দেখার আগে দূরে থেকে তাকে দুইবার দেখেছি। মুগ্ধ হয়েছি। তার আখলাকে সমর্পিত হয়েছি।

আমি সবে ঢাকা এসেছি। এসেই ভর্তি হয়েছ যাত্রাবাড়ী মাদরাসায়। সে বছরই লালবাগ ছেড়ে যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় এসেছেন তিনি। একদিন দুপুর বেলা লক্ষ করলাম, ছাত্রদের মধ্যে বেশ উদ্যম ও উত্তেজনা। প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আজকের সীরাতুন্নবী মাহফিলের বক্তা মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ সাহেব এবং যাত্রাবাড়ী মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেব। তারা তাদের মতাে করে সেই উত্তেজনার কারণও বলল। সত্যি কথা কি, সেই বয়সে ঢাকায় এসে যে কয়টা জায়গার টানে আমার প্রিয় গ্রামকে ভুলে থাকতে পেরেছিলাম তার মধ্যে এই বায়তুল মােকাররম অন্যতম।

এত বিশাল এত সুন্দর মসজিদ। পরে অবশ্য এর বিশালায়তন পাঠাগারটিরও প্রেমে পড়েছিলাম। আমি সহপাঠীদের সঙ্গে চলে এলাম ফাউন্ডেশনের মাহফিলে, বায়তুল মােকাররমের টানে কিংবা তাদের উত্তেজনার ঝড়ে।

মাগরিবের পরপরই বায়তুল মােকাররমের পূর্বপ্রাঙ্গন কানায় কানায় পূর্ণ। শুরুতেই তিলাওয়াত ও প্রখ্যাত শিল্পীদের কণ্ঠে হামদ-নাত। আমার কাছে সব কিছুই অপূর্ব! আমি আবেগে আনন্দে মথিত অবাক! তারপর উপস্থাপক বক্তার নাম ঘােষণা করলেন। চেয়ারে আসীন হলেন মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.।

অবয়বে খর্বকায়। সাদামাটা পােশাক। হাস্যোজ্জ্বল মুখ। হাসিতে সারল্যের দীপ্তি । অতঃপর কাজী নজরুল ইসলামের দ্রোহ ও সৃষ্টিগুণের উল্লাসকে কণ্ঠে ধারণ করে প্রবাহিত করে চললেন আবেগ, বিশ্বাস ও জ্ঞানের ঝরনা। হযরত আলী ও মা ফাতেমাধর্মী ওয়াজ শুনে আসা আমার কাছে ছিল এক নতুন দিগন্তের সাক্ষাৎ!

তার আলােচনার শেষের দিকে হঠাৎ করেই উদিত হলেন মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেব। আমার সঙ্গীরা ফিসফিসিয়ে আঙুল উঁচিয়ে দেখাতে লাগল তাকে। মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেব সিঁড়ির কাছে আসতেই দরিয়াদিল কাজী সাহেব আসন ছেড়ে ছুটে গেলেন সিঁড়ির দিকে। গুরু-শিষ্য আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন উষ্ণ আবেগে।

তারপর কাজী সাহেব হুজুর মাহমুদ সাহেবকে চেয়ারে বসার জন্যে পীড়াপীড়ি শুরু করেন। মাহমুদ সাহেব আদবের সঙ্গে চেয়ারের পাশে মেঝেতে বসে পড়েন। কাজী সাহেব হুজুর পূর্ব আলােচনায় ফিরে না গিয়ে মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেবের ভূয়সী প্রশংসা করে বক্তৃতার ইতি টানেন।

সভা শেষে মাদরাসায় ফিরে বন্ধুরা কে কী ভেবেছিল, তা বলাবলি করছিল। অনেকের কণ্ঠেই ঝরে পড়ছিল রাজ্যের বিস্ময়-দেখনি, কাজী সাবের আচরণ..।' আমি ঢাকায় এসেছি সবে। চর্চিত ইতিহাসের কিছুই আমি তখন বুঝিনি। শুধু বুঝেছি, মানুষের মুখে মুখে কত।

পরের বছর যাত্রাবাড়ী ছেড়ে চলে এলাম ফরিদাবাদ মাদরাসায়। মানসগঠন ও স্বপ্নের দিক আবিষ্কারে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদান কোনো দিন ভুলবো না।  যাদের কাছে পড়েছি তাদের সকলেরই ছিল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। আর সকলে ভালাে মানুষ। বিদ্বান মানুষের অভাব হয় আমি জানি না। তবে ভালাে মানুষের সবকালেই সােনার হরিণ ধরার মতােই দুর্লভ। এই ফরিদাবাদে আমাদের উত্তর হযরত মাওলানা বশীর উদ্দিন সাহেব দামাত বারাকাতুহুম।

এখন নরসিংদী দল মাদরাসার শায়খুল হাদীস। সন্ধ্যা নেমে এলে হাস-মুরগির শিশুরা যেমন মায়েদের নিচে এসে জড়াে হয়, আমাদের অবস্থা ছিল অনেকটা সেই রকম। অবসর পেলেই দলবেধে ছুটে যেতাম তাঁর ঘরে। তিনি যেমন দক্ষ শিক্ষক তেমনি দগ্ধ অনুবাদক। আমরা গেলে কলম বন্ধ করে বসতেন। হাসতেন। শুরু হত গল্প বলা। স্বপ্নপুরী দারুল উলূম দেওবন্দই ছিল।

সেই গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয়। তারপরও গল্পের ফাঁকে ফাঁকে অভাবিত শ্রদ্ধায় শিশিরের মতাে। করে পড়ত তিনটি নাম-কাজী মুতাসিম বিল্লাহ, নুর হােছাইন কাসেমী এবং ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। হুজুরের ভাষায়- কাজী সাব হুজুর, নূর হুসেন সাব হুজুর, ফরীদ সাব হুজুর। সত্যি কথা কি, আমার গ্রাম থেকে আনা মােমের সরল আয়নায় এভাবেই নির্মিত হয় একটি স্বপ্নের ছবি।

সেই ছবির মাঝখানে দারুল উলুম দেওবন্দ, আর তার চারপাশে সেই দারুল উলুমের কীর্তিমান সন্তান মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ, মাওলানা নুর হুসাইন কাসেমী, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ এবং প্রিয় উস্তায মাওলানা বশীর উদ্দিন সাহেব দামাত বারাকাতুহুম।

ফরিদাবাদ মাদরাসায় তখন বাংলাদেশ বেফাকুল মাদারিসের কেন্দ্রীয় দপ্তর। বেফাকে বার্ষিক সভা ও অন্যান্য উপলক্ষে দেশবরেণ্য আলেমগণের নয়নকাড়া সমাবেশ হত। দেশের খ্যাতিমান আলেমদের শওকতপূর্ণ উপস্থিতির পরশে বুকটা ফুলে উঠত। কওঁ ফিসফিসানির ঝড় উঠত-ফরীদ সাব ফরীদ সাব কিংবা নুর হােসেন সাব-তখন কে মনে হত আনন্দে গর্বে মাথাটা আকাশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

সেই সময়টাতে ফরিদাবাদে ২ লাঙ্গনে প্রিয় উস্তাযের প্রিয়তম উস্তায কাজী সাহেব হুজুরকে দেখেছি মনে করতে। তবে সবিশেষ হযরতুল উস্তায মাওলানা বশীর উদ্দীন সাহেব ছাড়াও হযরত মাওলানা মান্নান সাহেব এবং হযরত মাওলানা রুহুল আমীন খান উজানবী সাহেবের মুখে নানাভাবে উচ্চারিত হত এই নাম। আমি অবাক হতাম, দেশের খ্যাতিমান আলেমগণের নাম উচ্চারিত ফুকাহায়ে কেরামের নামের মতাে দরকারী ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছেন।

কাজী সাহেব কিংবা ফরীদ সাহেবের নাম আসত কণ্ঠ কেমন অব্যক্ত শ্রদ্ধায় নমিত হত। সেই কিশােরমনে অনুভব করতাম, এই নাম হৃদয়ে লালিত অসীম শ্রদ্ধায়।

সেটা প্রেসিডেন্ট এরশাদের কাল। নির্বাচন হল। মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস সাহেব। বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হলেন। তখনকার একটা ঘটনা। মুফতি ওয়াক্কাস সাহেবের উদ্যোগে ঢাকার বায়তুল মােকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন হলে একটি সেমিনার হল। বিষয় দারুল উলম দেওবন্দ। শুনলাম, কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ সাহেব হুজুর মুফতি ওয়াক্কাস সাহেবেরও উস্তায়।

এই সভার মুখ্য বক্তা তিনিই। অসীম আবেগে ছুটে গেলাম। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই হল কানায় কানায় পূর্ণ। পেছনে যখন আর দাঁড়াবার জায়গা হচ্ছে না তখন হযরত মাওলানা ইসমাঈল বরিশালী- পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বেফাকুল মাদারিসের প্রখ্যাত ও প্রাজ্ঞতম পরীক্ষানিয়ন্ত্রক- এবং হযরত মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ হলের সামনে গিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লেন। তাদের দেখাদেখি এক বিশাল কাফেলা ফ্লোরে আসন গ্রহণ করে। মাত্র দুই মিনিট বক্তৃতা করলেন হযরতুল উস্তায মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। বললেন-“দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়াতের কথা আমরা কেন বলি? আমাদের জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা কী? দেওবন্দ হল, আমাদের জন্যে নববী ইলমের সনদ। তারপর এ বিষয়ে সবিস্তারে আলােচনা করবেন দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়াতের প্রাজ্ঞ মুখপাত্র, আমাদের উস্তায কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ দামাত বারাকাতুহুম। চয়িত শব্দের সানিন্দ্য উচ্চারণ, বয়িত বক্তৃতা বিদ্যুৎচ্ছটার মতাে আমাদের চকিত করে গেল। ঠিক বুঝে ওঠার আগেই শেষ। দাঁড়ালেন মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস এমপি। দেওবন্দ ও আলিয়া মাদরাসা নববী ইলমের দুটি শাখা। এই ছিল তার খােলাসাকথা। তিনিও পাঁচ মিনিটের মধ্যে কথা গুটিয়ে উচ্চারণ করলেন একই ভঙ্গিতে-এ বিষয়ে সবিস্তারে আলােচনা করবেন আমাদের উস্তায দেশের প্রখ্যাত শায়খুল হাদীস ও হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানীর যােগ্য উত্তরসূরি হযরত মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ। অনুষ্ঠানটা কে যেন উপস্থাপন করেছিল। স্মার্ট, নান্দনিক এবং মেদহীন বিশেষণের পর।

বিশেষণের ক্লান্তিকর কাব্যিকতা নয়। দেশের প্রখ্যাত আলেমে দীন, গবেষক, চিন্তাবিদ মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ। সাদাসিধে পােশাক। মুখে দাড়ি ও হাসির যুগল দীপ্তি। অতঃপর মাইকের সামনে দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়াতের পরিচয় ও অবদানের উত্তাল উচ্চারণ-যেন এক অথৈ সমুদ্র গভীর বিশ্বাসে আর মথিত আবেগে চয়িত শব্দাবলীর নিখুঁত বিন্যাসে অবিরাম ঢেউ ভেঙ্গে চলছেন। তীরে বসে আমরা যুগপৎ মুগ্ধ হচ্ছি, শপথে হচ্ছি মুষ্ঠিবদ্ধ। তথ্য, আবেগ, ভাষা ও ভালােবাসার সেই আলােড়ন এখনাে অন্তরে অনুভব করি, অথচ আরও তিরিশ বছর আগের কাহিনী।

বিদ্বান মানুষের তাে অভাব হয় না। কিন্তু আমার ও আমাকে দেওবন্দের এমন আবেগােষ্ণ প্রেমিক কি আর পাব? এখানেই সালাফ ও আমাদের পার্থক্য। কালের কর্ষণে জীবনে বাড়ছে বেগ আর ক্রমাগত হারাচ্ছে আবেগ। লাভ-লোকসানের জরিপ নগ্ন থেকে নগ্নতর হচ্ছে, আর হারিয়ে যাচ্ছে প্রেম ও ভালােবাসার অকৃত্রিম সব উপমা।

বিনয় আমাদের ধর্মের গুপ্তধন। এই ধন হৃদয়ের সিন্দুকে যতনে কোনাে কালেই অনেক হয় না। কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ সাহেবকে যারা যে যত বেশি দেখেছেন, যত ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন, তিনি ততটাই জোর দিয়ে বলবেন, বিনয়ে তিনি ছিলেন তাঁর কালের শ্রেষ্ঠ উপমা। আমাদের প্রিয়তম নবী সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর তরে বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাআলা তাকে উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেন।’ আমাদের কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. সেই উচ্চতায় প্রতিটি সমকালীন উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে তাঁর আমল ছিল অতি উচ্চে। সবিশেষ তার শিষ্যভাগ্য ছিল বিরল। কালের অনেক অনন্য প্রতিভা তার ছাত্র । মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ, মাওলানা আবদুর রহমান হাফেজ্জী, মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ উবায়দুল্লাহ, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহই মাওলানা, মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী রহ., ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ, মাওলানা আ ব মা সাইফুল ইসলাম, মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন, মাওলানা আবু সাবের আবদুল্লাহ, মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ এবং মাওলানা আব্দুল গাফফার; তারা সকলেই জ্ঞান, প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতির। সমুজ্জ্বল নক্ষত্র।

সুপ্রতিষ্ঠিত অবিসংবাদিত এই নক্ষত্রপুরুসের জীনব্যাপী ছিল বিনয়ের দীপ্তি। তাঁর পরিচিত ছাত্র-ভক্তদের দেখা বিনয়ের ঘটনাবলী যদি একত্র করা হয় তাহলে একখানা বৃহদাকার গ্রন্থ তৈরি হবে সন্দেহ নেই। আমার দেখা অনেক ঘটনার একটি বলি। আমার শ্বশুর মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ.-এর সঙ্গে একবার হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দীর্ঘসময় নানা বিষয়ে অনেক কথা হল। যখন ফেরার সময় হল, আমার শ্বশুর বিনয়ের সঙ্গে আরজ করলেন, ‘হার্টে সমস্যা দেখা দিয়েছে। শরীর ভালাে যাচ্ছে না। হুজুর একটু ফু দিয়ে। দিন’-বলে টুপি খুলে মাথা নামিয়ে দিলেন। হুজুর সঙ্গে সঙ্গে অসামান্য আবেগ ও উৎসাহ নিয়ে নিজের টুপি খুলে মাথা নমিত করে বললেন, আপনি বুযুর্গ মানুষ, আপনি আমার মাথায় ফু দিয়ে দিন। অতঃপর আমি আপনাকে ফু দেব। অগত্যা আমার শ্বশুরকে তাই করতে হয়েছে।

তাঁর এই অনুপম বিনয়ের উপমা তাঁর লেখা থেকে দিই। আমাদের উস্তায হলমাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ তার প্রিয় ছাত্রদের অন্যতম। তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর’ এর ভূমিকায় লিখেছেন-‘জনাব মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সাহেবের জ্ঞান-গরিমার পরিচয় দান করতে যাওয়া আমার পক্ষে পিদিম হয়ে সূর্যের আলাের পরিচয়দানের মতাে ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছুই হবে না। বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি। একদিকে তাে তিনি অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী, বহুগ্রন্থ রচয়িতা, সুসাহিত্যিক বলে পরিচিত ছিলেন। এখন তাে তিনি অতি উচ্চস্তরের অলীআল্লাহও বটে। জানেশীনে শায়খুল ইসলাম, মুরশিদুল আলম, কুতুবুল আলম, হযরত মাওলানা সায়্যদি আসআদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুমের দস্তে মুবারকে বায়আত করার এক বছরের মাঝেই খেলাফত লাভে ধন্য হলেন। বর্তমানে হযরত মুরশিদুল আলমের নেকনজর ও স্নেহধন্য দু-চারজনের কাতারে তিনি পৌঁছে গেছেন। ইউরােপ-আমেরিকায় ইসলাহ ও তাবলীগের সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন বারবার। আল্লাহ তাআলা মাওলানাকে সুস্থতার সঙ্গে শতায়ু দান করুন। দারাজাত বুলন্দ করুন। আমার মতাে পাপীতাপীদের নাজাতের উসিলা বানিয়ে দিন তাকে। আমীন! তার শুকরিয়া আদায় করে তাকে খাটো করতে চাই না।'

এই হল কাজী সাহেবের বিনয়। কে বলবে, উস্তাদ লিখছেন তাঁর ছাত্র সম্পর্কে! তাঁর জীবনের ছত্রে ছত্রে ছড়ানাে ছিল এই বিনয়ের নির্মল আভা। আজ আমাদের এই আভারই অভাব। এই অভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। পৃথিবী তখনই হারাল বিনয় ও আদর্শের বিমূর্ত ছবি কাজী মুতাসিম বিল্লাহকে। হায়, নবীজির বাণী ছবি হয়ে আর ফিরবে না আমাদের মাহফিলে।

(২০১৭ সালে জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘শায়খুল হাদীস আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. স্মারক গ্রন্থ’ থেকে নেয়া।)

লেখক: উস্তাযুল হাদীস, দারুল উলুম আজমিয়া, বনশ্রী।

-এএ/এটি


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ